|
|
|
|
স্মরণ ১... |
|
হরিভাইকে আমি বলি বলিউডের দ্রাবিড়
বেঁচে থাকলে এ বছর তাঁর বয়স হত পঁচাত্তর। চাপের মুখে, ছবির সম্ভাব্য পতনের
সামনে চিত্রনাট্যকে বাঁচিয়ে গিয়েছেন বার বার।
প্রয়াত এবং প্রায় বিস্মৃত সঞ্জীব কুমারের
রোমন্থনে মুম্বই থেকে চিত্রনাট্যকার
সেলিম খান। শুনলেন
গৌতম ভট্টাচার্য |
|
...সত্যি বলতে কী আমার খেয়ালই ছিল না এই জুলাইতে বেঁচে থাকলে সঞ্জীব কুমারের যে পঁচাত্তর বছর হত! সঞ্জীব কুমার নামেই বিখ্যাত। সবার কাছে পরিচিত। আমরা ডাকতাম হরিভাই।
মারা গেল, যখন মারা যাওয়ার বয়সই হয়নি মাত্র সাতচল্লিশ। ওদের পরিবারে অবশ্য সবারই কমবেশি হার্টের প্রবলেম। ওর ছোট ভাই, বাবা, সবাই কম বয়সে মারা গিয়েছে। আমরা বহু বার বলেওছি, হরিভাই শরীরের যত্ন নাও। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে সংযত থাকো। ও সেটা পারেনি। ড্রিংক যেমন খুব বেশি করত, তেমনই অসম্ভব পেটুক ছিল। তখন অবশ্য এত শরীরচর্চার চলও ছিল না। সে যুগে কোনও কোনও হিরো হয়তো চেহারা ঠিক রাখার জন্য হাল্কা ডন বৈঠক করে নিত। কেউ বড়জোর ব্যাডমিন্টন খেলে নিল। এখনকার যুগে এ সব অকল্পনীয়। প্রত্যেককে জিম করতে হয়। শরীর অসম্ভব ফিট রাখতে হয়। আমরা অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে হরিভাই, চেহারাটা যদি কন্ট্রোলে রাখতে পারো, তোমার জন্য অনেক ভাল রোল অপেক্ষা করে থাকবে। বেশ কিছু রোল তুমি মিস করে যাচ্ছ ওয়েট বাড়িয়ে ফেলায়। খাওয়াটা কমাও। কে কার কথা শোনে!
হরিভাই যখন প্রথম এই প্রফেশনে আসে, শুরুর দিকে একটা ছবি পেয়েছিল ‘সংঘর্ষ’। দিলীপ কুমারের সঙ্গে। যে কোনও কেউ কেরিয়ারের শুরুতে অত বড় স্টারের সামনে ঘাবড়ে যেত। অথচ আমরা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে হরিভাই এতটুকু ঘাবড়ায়নি। কাজটা কী সুন্দর তুলে দিয়েছিল। না কোনও ইনস্টিটিউটে কখনও অভিনয় শিখেছে, না গিয়েছিল কোনও ওয়ার্কশপে। সাধারণ থিয়েটারের ব্যাকগ্রাউন্ড। আর পাঁচটা লোকের যেমন থাকে।
ওকে দেখে আমি আরও নিশ্চিত হই যে কোনও কোনও প্রফেশন আছে, যেখানে শিখিয়ে পড়িয়ে কাউকে বানানো যায় না। একটা বেসিক স্কিল আপনার থাকতেই হবে। যেমন কবি হতে গেলে। ছবি আঁকতে গেলে। অভিনয় করতে হলে। হরিভাইয়ের মধ্যে সেটা ছিল। আমি আদ্যন্ত ক্রিকেট-ভক্ত বলে একটা অভ্যেস নিজের মধ্যে চিরকাল থেকে গিয়েছে। কাউকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নাম করতে দেখলে তার একটা ক্রিকেটীয় প্যারালাল খুঁজি। দিলীপকুমারের পাশে রাখার মতো যেমন পাই একমাত্র সচিন তেন্ডুলকরকে। বলিউডে দুটোই যুগ। দিলীপকুমার-পূর্ব আর উত্তর। ইন্ডিয়ান ক্রিকেটেও তাই। সচিন-পূর্ব আর সচিন-উত্তর।
হরিভাই কার সঙ্গে তুলনীয় হবে।
উত্তরটা খুব সহজ রাহুল দ্রাবিড়। কী কী সিনেমায় কাজ করেছে হরিভাই! ‘কোশিশ’, ‘আঁধি’, ‘সিলসিলা’। কোথাও ওকে নিয়ে বাড়তি কোনও নাচানাচি নেই। বাজনাবাদ্যি নেই। গ্ল্যামারের চুম্বকটাও টেনে নিয়েছে অনিবার্য ভাবে অন্য কেউ। অথচ কাজের কাজটা হরিভাইই করে গেছে। চাপের মুখে, ছবির সম্ভাব্য পতনের মুখে সব সময় চিত্রনাট্যকে বাঁচিয়ে গিয়েছে হরিভাই। ঠিক দ্রাবিড় যা! আদ্যন্ত টিমম্যান।
অভিনেতা হিসেবে আমার দেখা সেরা পাঁচ জনের মধ্যে ওকে অবশ্যই ফেলব। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নম্বর মার্কিংয়ের বিরুদ্ধে। আর অভিনেতাদের মধ্যে একজন সম্পর্কে আমি এতটাই অনুরক্ত যে ওঁকে একটা সরণিতে রেখে তার পর বাকিদের আরেকটায় রাখি। তাঁর নাম দিলীপ কুমার।
‘শক্তি’তে আমি আর জাভেদই (জাভেদ আখতার) সংলাপ লিখেছিলাম। তার পর যখন ছবিটা রিলিজ হল, দেখলাম সংলাপে-অভিব্যক্তিতে না-বলা কথায় দিলীপ সাব অত্যাশ্চর্য উত্তরণ ঘটিয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে আমি দু’টো নাম করব। অমিতাভ বচ্চন আর সঞ্জীব কুমার। ‘জঞ্জীর’-এ অমিতাভ এ রকমই সংলাপ ছাপিয়ে বাড়তি কিছু যোগ করেছিল। ‘দিওয়ার’-এ করেছিল। তেমনই হরিভাই করেছিল ‘ত্রিশূল’ আর ‘শোলে’তে।
|
|
ত্রিশূল |
‘ত্রিশূল’-এর পর আমরা একসঙ্গে কাজ করিনি। তবে বন্ধুত্বটা আগাগোড়া ছিল। আমার যেটা সব চেয়ে ভাল লাগত, ওর বহুমুখিতা। কত রকমের চরিত্র করত। নিজের এত কম বয়সে ও যে এক কথায় কত বৃদ্ধের রোল করতে রাজি হয়ে গিয়েছে, ভাবাই যায় না। সাধারণত নায়কদের দেখেছি এ সব ব্যাপারে ভীষণ ছুঁৎমার্গ থাকে। নিজের বয়সের বাইরে কেউ চট করে যেতে চায় না। হরিভাই এ সব পাত্তাই দেয়নি।
রাজেশ খন্না মারা যাওয়ার পর আমায় কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছে, আচ্ছা অভিনেতা হিসেবে কাকে আগে রাখবেন? রাজেশ না সঞ্জীব? আমার মতে তুলনাটাই হয় না। রাজেশ অনেক স্টাইলাইজড অভিনয় করত। ওর ফান্ডা ছিল নাটক আর রোম্যান্সে। হরিভাই অনেক সূক্ষ্ম।
সব চেয়ে বড় কথা, কমেডি অভিনয়ে ও তুখোড় ছিল। সব রকমের অভিনয়ের মধ্যে কমেডি করাটা সব চেয়ে কঠিন। টাইমিংটা অসম্ভব ভাল ছিল হরিভাইয়ের। এত সহজে কমেডি সিকোয়েন্সগুলো ও উতরে দিত, যে ভাবাই যায় না। কী নতুন পরিচালক, কী পোড় খাওয়া মাথা সবাইকে এক কথায় উদ্ধার করে দিত।
প্রেম-ব্যথা-নিঃসঙ্গতা এ সব ওর জীবনে ছিল। ছিল আঘাত পাওয়াও। কিন্তু সে কার জীবনেই বা না থাকে? বলিউডে এমন কেউ আছে যে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে তার জীবনে এ সব ঘটেনি? নিঃসঙ্গতা আর প্রেমে ব্যর্থতা মোটেও ওর আকস্মিক মৃত্যুর কারণ নয়।
আমাদের চিত্রনাট্য লেখার বাইরে ‘আঁধি’তে দারুণ কাজ করেছিল। আর ‘শোলে’তে হরিভাইয়ের অভিনয় কে ভুলবে! দুটো হাত কাটা অবস্থায় ওই যে ডায়ালগটা, ‘ইয়ে হাত মুঝে দে দে গব্বর’। চাউনিটাই তো শুধু অমর হয়ে থাকবে। অমর হয়ে যাওয়া ফিল্মের মতো।
যে চলে গিয়েছে তাকে আর কে মনে রাখে। বলিউডের চাকা ঘোরে তার নিয়মে। যে পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছে তার আর কী দাম! সে শুধু থেকে যায় স্মৃতিতে-ভালবাসায়-পুরোনো ছবিতে। আমার কাছে পুরোনো কীর্তিতেও।
আমার ছেলে সলমনকে যদি আমায় বলতে হয় প্রয়াত বন্ধুর জীবন থেকে কী শিখবে, তা হলে বলব লোকটার মতো চ্যালেঞ্জ নিতে শেখো ... |
|
|
|
|
|