আইন আছে। তবে নজরদারি নেই। সাধ থাকলেও পরিকাঠামোর অভাবে আইন মানানোর সাধ্য নেই প্রশাসনের।
ফলে আইন মানার গরজও নেই। কাগুজে নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্য জুড়ে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ চলছে অবাধে। গ্রাম-গঞ্জ-মফস্সল থেকে খাস কলকাতায় তার রমরমা কারবার। পরিস্থিতি সামলাতে স্বাস্থ্য দফতর এ বার ডাক্তারদের বিধির শৃঙ্খলায় বাঁধতে চাইছে। কিন্তু নয়া দাওয়াই দিলেও তা কার্যকর করার মতো পরিকাঠামো যে তাঁদের নেই, স্বাস্থ্য-কর্তারা তা-ও খোলসা করে দিচ্ছেন।
অর্থাৎ, ঘুরে-ফিরে তাঁদের দিশেহারা ভাবটাই প্রকট। বস্তুতই পরিস্থিতি এখন রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভ্রূণ-লিঙ্গ প্রকাশের অভিযোগে গত তিন মাসে কলকাতা ও শহরতলির চার-চারটে ক্লিনিককে সিল করেছে স্বাস্থ্য দফতর। এর মধ্যে রয়েছে পূর্ব কলকাতার একটা নামী নার্সিংহোম। নজরদারিতে ঘাটতির সুযোগে বিভিন্ন জেলায় রীতিমতো ভ্র্যাম্যমান ক্লিনিক চালু হয়ে গিয়েছে। আল্ট্রাসোনোগ্রাফির সাজ-সরঞ্জাম চড়িয়ে ভ্যান ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামে-গঞ্জে। সেখানেই গর্ভবতীর ভ্রূণের লিঙ্গ জেনে পরিবারকে বলে দেওয়া হচ্ছে। এ ভাবে কত ‘কাস্টমার’কে পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে, তার কোনও হিসেব থাকছে না।
আইনভঙ্গের এ হেন বাড়বাড়ন্তেই লাগাম দিতে সরকার এখন চিকিৎসকদের উপরে বিধি-নিষেধ আরোপ করতে চলেছে। কী রকম?
স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: নতুন নিয়মে এক জন ডাক্তার পাঁচটির বেশি সোনোগ্রাফি কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। যে ক’টায় তিনি রোগী দেখবেন, প্রতিটির ক্ষেত্রে তাঁকে আলাদা আলাদা সরকারি অনুমতি নিতে হবে। নিয়ম ভাঙলে ডাক্তার ও ক্লিনিক দু’পক্ষকেই ধরা হবে। যদিও চিকিৎসকদের এই নিয়ম মানতে বাধ্য করা যাবে কী ভাবে, সে সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন স্বাস্থ্য-কর্তাদেরই একাংশ। দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “বহু ডাক্তার ও টেকনিসিয়ান মুখে কিছু না-বলে স্রেফ হাতের মুদ্রায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন, গর্ভস্থ সন্তান ছেলে না মেয়ে! আটকাব কী ভাবে?”
আটকানো যাচ্ছেও না। তাই অলি-গলিতে চুটিয়ে চলছে অবৈধ ব্যবসা। যা নিয়ে রাজ্য মহিলা কমিশন ইতিমধ্যে ক্ষোভ জানিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরে। কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “খাস কলকাতার বুকে রমরমিয়ে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ চলছে। গত বছর হাওড়ার রঞ্জনা
প্রসাদ নামে যে মেয়েটি গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্টের চেষ্টার প্রতিবাদ করেছিল, তাকে কিন্তু কলকাতার ক্লিনিকেই এনেছিলেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শহরে যখন এমন অবস্থা, তখন জেলার হাল সহজেই অনুমেয়।” জেলায় কী অবস্থা?
স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট বলছে, দুই ২৪ পরগনা-হুগলি-জলপাইগুড়ি-উত্তর দিনাজপুরের হাল সবচেয়ে খারাপ। নমুনা হিসেবে জলপাইগুড়িকে ধরা যেতে পারে। সেখানে ৩৫টি আলট্রাসোনোগ্রাফি ক্লিনিকের কাছ থেকে গত এক বছরে ‘ফর্ম এফ’ মিলেছে মাত্র ১২টি। এটা অস্বাভাবিক কেন?
প্রি কনসেপশন অ্যান্ড প্রি নেটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিকস (প্রহিবিশন অ্যান্ড সেক্স সিলেকশন) অ্যাক্ট, ১৯৯৪ অনুযায়ী আলট্রাসোনোগ্রাফির আগে ক্ষেত্রে ফর্ম এফ পূরণ বাধ্যতামূলক। যিনি সোনোগ্রাফি করাচ্ছেন, সেই মহিলা সম্পর্কে ওই ফর্মে থাকতে হবে যাবতীয় তথ্য বয়স, সন্তানসংখ্যা, আগের সন্তান পুত্র না কন্যা, আগে গর্ভপাত ঘটেছে কি না ইত্যাদি। ফর্মগুলো নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্বাস্থ্য দফতরে জমা পড়ার কথা। “জলপাইগুড়িতে ফর্ম এফ জমার সংখ্যা থেকেই বিধিভঙ্গের বহরটা আঁচ করা যায়।” বলছেন এক স্বাস্থ্য-কর্তা। তাঁর আক্ষেপ, “ফর্ম ফিল-আপ হচ্ছে কি না, কিংবা যন্ত্রের সরকারি রেজিস্ট্রেশন আছে কি না, এ সব যাচাই করা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু লোকের অভাবে করা যাচ্ছে না। সব জেনেও হাত গুটিয়ে থাকতে হচ্ছে।”
আর তাই দরজায় ‘ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ হয় না’ লেখা বোর্ড ঝুলিয়েই দায়িত্ব সেরে ফেলছে অধিকাংশ ক্লিনিক। দফতরের যখন এমন নিধিরাম অবস্থা, তখন ডাক্তারদের উপরে নিয়ম আরোপ করে কতটা লাভ হবে?
স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীও নিজেও বিশেষ আশাবাদী নন। “মূল সমস্যাটা লোকবল।
নিয়মিত পরিদর্শন না-হলে যে কোনও নিয়মই কাগজে-কলমে থেকে যায়।” মন্তব্য অধিকর্তার। লোকবল অচিরে বাড়বে, এমন আশাও দিতে পারছেন না স্বাস্থ্য-কর্তারা। পরিবর্তে আরও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে যুক্ত করার পরিকল্পনা হয়েছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
অতএব বজ্র আঁটুনি যতই থাকুক, ফস্কা গেরোর ট্র্যাডিশনই আপাতত চলবে। |