সম্পাদকীয় ১...
কূটনীতির দায়
তঃপর ভারতীয় কূটনীতির ইতিহাসে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক তিন দিনের বাংলাদেশ সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে গণিত হইবে। বহু কাল পর কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ঢাকায় পা রাখিলেন, ঊনচল্লিশ বৎসর আগে রাখিয়াছিলেন প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি। বাস্তবিক, উচ্চতম ভারতীয় পদাধিকারীদের বাংলাদেশ বিষয়ে এই নির্বিকারত্ব বাংলাদেশকে হয়তো ক্ষুণ্ণ করিতেছিল। প্রণব মুখোপাধ্যায় কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করিবার পর প্রথম বিদেশ সফর হিসাবেই বাছিয়া লইলেন ঢাকা। বোঝা যায়, ভারতের কূটনীতি মানচিত্রে বাংলাদেশের স্থান পাল্টাইতেছে। কিন্তু কেবল সফরের সিদ্ধান্তটি নহে, সফর বাতিল না করিয়া পূর্বনির্ধারিত সূচিই স্থির রাখিবার সিদ্ধান্তও ইহার ঐতিহাসিকতার কারণ। শাহবাগ আন্দোলন চলাকালীন, প্রবল রাজনৈতিক উত্তেজনা, হিংসা, সংকট ও তীক্ষ্ণ জাতীয় দ্বিধাবিভাজনের প্রেক্ষিতে যখন ভারতীয় রাষ্ট্রপতির এয়ার ফোর্স ওয়ান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করিল, সেই সময়েই অলক্ষ্যে ইতিহাসপৃষ্ঠায় এই সফরের স্থায়ী স্থান নির্ধারিত হইল।
রাজাকারদের চরম শাস্তিদানের দাবি হইতে বাংলাদেশের এই বিপুল জন-আন্দোলন ইতিমধ্যেই জামাত-এ-ইসলামি তথা জঙ্গি ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে অভিযানে পর্যবসিত। জামাতকে নিষিদ্ধ করিবার দাবিও উঠিয়াছে, শেখ হাসিনার সরকার গুরুত্ব দিয়া সে দাবি বিবেচনা করিতেছে। বিরোধী দল বিএনপি জামাতের সহিত হাত মিলাইয়া সরকার-বিরোধিতার সুর চড়াইতেছে: এক বৎসরের মধ্যে সে দেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া দুই পক্ষই আপাতত তীব্র যুযুধান। ভুলিলে চলিবে না, জামাত গোষ্ঠীর অন্যতম মূল অ্যাজেন্ডা কিন্তু ভারত-বিরোধিতা, ভারতীয় রাজনৈতিক স্বার্থ বা অর্থনৈতিক স্বার্থের সহিত বাংলাদেশে স্বার্থ-সংঘাতের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা। বিপরীতে, হাসিনার নেতৃত্বে শাসক দল আওয়ামি লিগ মূলত ‘ভারতবন্ধু’, অন্তত বিরোধীদের চোখে তাহাই শাসক সরকারের প্রধান দুর্বলতা! এই প্রেক্ষিতে বিচার করিলে, প্রণব মুখোপাধ্যায় যতই নিজের সফরকে অরাজনৈতিক বলুন না কেন, রাজাকার-বিরোধী, মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের শিখর-চুম্বিতার মুহূর্তে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর এই সাদর কূটনীতি আলোচনা ও আন্তরিক সম্পর্কের প্রদর্শনের মধ্যে ভারতের দিক হইতে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা রহিয়াছে। এত বড় রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যেও রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গীদের মাধ্যমে তিস্তা চুক্তির জট ছাড়াইবার ব্যস্ততাকে বর্তমান সরকারের হাত শক্ত করারই রাজনৈতিক প্রয়াস বলিয়া মনে করিবার যুক্তি আছে। আন্দোলনের সপক্ষে (রাষ্ট্রপতির ভাষায় ‘ন্যায়ের সপক্ষে’), হাসিনা সরকারের সপক্ষে ভারতের রাজনৈতিক সমর্থন এখন খরসূর্যালোকের মতো চোখধাঁধানো সত্য।
বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী বিএনপি-প্রধান খালেদা জিয়া গোটা বিষয়টিতে বিষম অপ্রীত। প্রণববাবুর সহিত সাক্ষাৎসূচিও বাতিল করিয়া তিনি সে কথা বুঝাইয়া দিয়াছেন, হাসিনার বিরুদ্ধে ভারতের তাঁবেগিরির অভিযোগও তুলিয়াছেন। ইহা বাংলাদেশের রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। এবং সেই প্রেক্ষিতেই একটি প্রশ্ন উঠিতে পারে। ভারতের নৈতিক অবস্থান যাহাই হউক, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার সহিত ভারতীয় কূটনীতিকে কতটা জড়াইয়া ফেলা সঙ্গত? কূটনৈতিক আদানপ্রদানের সহিত যে নৈতিক বিবেচনা মিশাইয়া ফেলা সঙ্গত নহে, সাম্প্রতিক ভারতীয় কূটনীতি এই মতেই চলিতেছে, অন্তত মায়ানমার বা ইরানের ক্ষেত্রে সেই দৃষ্টান্তই দেখা গিয়াছে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থনদান একটি গুরুতর কর্তব্য নিশ্চয়ই, তবে কূটনীতির পথ এবং মাত্রা নির্ধারণে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করাও জরুরি। সেই সমগ্রের ভিতর ভবিষ্যৎও আছে। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এবং সরকারের ভবিষ্যৎ এক নয়। ভারত ও বাংলাদেশ, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কী সম্পর্ক হইবে, তাহা দুই সরকারের পারস্পরিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে স্থিত একটি প্রশ্ন। কূটনীতি কিন্তু সেই প্রশ্নের সম্যক বিবেচনা দাবি করে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.