মরচে পড়া এক ফুটব্রিজ। তার লোহার পাটাতন জুড়ে নানা মাপের গর্ত। সিঁড়ির দশাও বেহাল। তাই বিপদ এড়াতে রাস্তা দিয়ে পারাপার করাই শ্রেয় বলে মনে করেন বিধান শিশু উদ্যান এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, “ওই ব্রিজে ওঠা তো দূর অস্ত্, ভেঙে পড়ার ভয়ে নীচ দিয়ে যেতেও বুক ঢিপঢিপ করে।”
অথচ, পথচারীরা যাতে নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারেন, সে জন্যই কলকাতা পুরসভা ও বিজ্ঞাপন সংস্থার যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ফুট ওভারব্রিজ। পুরসভা সূত্রের খবর, শিয়ালদহ, রাজাবাজার, কাঁকুড়গাছি, উল্টোডাঙা, পার্ক সার্কাস, ঢাকুরিয়া ও বালিগঞ্জ এই সাতটি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এমন ব্রিজ তৈরি হয়। পুর-কর্তৃপক্ষের অবশ্য যুক্তি, যৌথ উদ্যোগে তাঁরা থাকলেও খরচ বহন থেকে রক্ষণাবেক্ষণ কোনও কিছুর খোঁজই তাঁরা রাখেন না। এমনকী, এ সংক্রান্ত কোনও কাগজপত্রও তাঁদের কাছে নেই।
নাগরিকদের অভিযোগ, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শহরের ফুটব্রিজগুলির নিরাপত্তা বদলে গিয়েছে বিপদে। বিধান শিশু উদ্যানের কাছে কাঁকুড়গাছি ফুটব্রিজ-ই তার ‘উজ্জ্বল’ উদাহরণ।
বাকিগুলির হাল? উল্টোডাঙা হাডকো মোড়ের কাছে সিআইটি রোডের উপরে কাঁকুড়গাছি ব্রিজ। এক দিকের ফুটপাথে বিধান শিশু উদ্যান ও একটি টেলিকম সংস্থার অফিস। অন্য দিকে ব্যাঙ্ক, বাজার। গোটা রাস্তার উপরে থাকা ওই ব্রিজে সিঁড়ির লোহার পাতে মরচে ধরেছে। কোথাও পাতের বেশ কিছুটা উধাও। রেলিংগুলিও মরচে ধরে নড়বড়ে। সব থেকে বিপজ্জনক অবস্থা ব্রিজের উপরে। মোট ২১টি লোহার প্লেট দিয়ে তৈরি ব্রিজের উপরের রাস্তার অধিকাংশ প্লেটে মরচে ধরে গর্ত তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা জয়তী ভট্টাচার্যের কথায়, “যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে ব্রিজটি। তাই বিপদ এড়াতে বেশ কিছুটা ঘুরে রাস্তা পেরোতে হয়।” শুধু তা-ই নয়, ওই ব্রিজে ভরদুপুরেও নেশাখোরেরা আড্ডা বসায় বলে অভিযোগ। |
প্রায় একই দশা এপিসি রোডের উপরে রাজাবাজার ফুট ওভারব্রিজটিরও। সিঁড়ির কংক্রিট ক্ষয়ে লোহা বেরিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়েও কাউকে ফুটব্রিজ ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। উল্টে ব্রিজে কয়েক জন ভবঘুরে শুয়ে ছিলেন। ব্রিজের স্তম্ভের নীচেই সংসার পেতেছে কয়েকটি পরিবার। স্থানীয় একটি কলেজের ছাত্রী রুম্পিতা সরকারের কথায়, “একে খাড়া সিঁড়ি। তার উপরে নানা সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা। নিরাপত্তার ভয়েই ফুটব্রিজ ব্যবহার করি না।” শিয়ালদহ ফুটব্রিজে ভাঙাচোরার সমস্যা না থাকলেও ব্রিজের মুখ জুড়ে অস্থায়ী দোকান, হকার। ফলে সে সব পেরিয়ে অনেকেই আর ফুটব্রিজ ব্যবহার করতে চান না। আবার পার্ক সার্কাস ফুটব্রিজে লিফ্ট থাকলেও তা সব সময়ে চলে না বলে অভিযোগ। ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জের ফুটব্রিজেরও একই হাল। ভরদুপুরে গুটিকয়েক লোকজন দেখা গেলেও বিকেলের পর থেকে তার সংখ্যা নেহাতই হাতেগোনা। অতগুলি এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফুটব্রিজ ব্যবহারের বদলে গাড়িঘোড়ার মাঝখান দিয়েই রাস্তা পেরিয়ে যান মানুষ।
কেন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না এই ব্রিজগুলির? কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, প্রতিটি ফুট ওভার ব্রিজই পুরসভা ও বিজ্ঞাপন সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ‘পিপিপি মডেল’-এ তৈরি হয়। কিন্তু ফুটব্রিজগুলির নক্শা ও গঠনসংক্রান্ত কাগজপত্র পুরসভার হাতে নেই। সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন কলকাতা পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষও। তিনি বলেন, “একমাত্র পার্ক সার্কাস ছাড়া বাকি ফুটওভার ব্রিজগুলির একটিরও ফাইল নেই আমাদের কাছে। ফলে সেগুলির নকশা বা অন্যান্য বিষয়ও জানা সম্ভব হচ্ছে না।” কিন্তু উল্টোডাঙা উড়ালপুলের ঘটনার পরে পুরসভা কি আদৌ নড়েচড়ে বসবে?
অতীনবাবুর দাবি, “উল্টোডাঙার ঘটনার পনেরো দিন আগেই বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলির সঙ্গে বৈঠক করে সব ফাইলপত্র চেয়েছি। তাঁরা সে সব জমা দেওয়ার পরে শহরের ফুটব্রিজ পরিদর্শন করা হবে। প্রয়োজনে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।”
শহরের প্রতিটি ফুটওভার ব্রিজই তৈরি হয়েছে লোহার কাঠামোর উপরে কংক্রিট কিংবা লোহার পাত পেতে। আর সেই স্ল্যাব কিংবা লোহার প্লেটের এত দিন কোনও রক্ষণাবেক্ষণ হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পুরসভার একটি সূত্রের দাবি, ব্রিজ তৈরির খরচ বহন থেকে পরে রক্ষণাবেক্ষণ সবই রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলির হাতেই। কিন্তু সংস্থাগুলি কী ভাবে ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তা নিয়ে ধন্দে পুরকর্তারাই। বিষয়টি মেনে নেন অতীনবাবুও। তাঁর অভিযোগ, বাম আমলে তৈরি হওয়া ফুট ওভার ব্রিজগুলির অধিকাংশই কার্যত অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এবং বিজ্ঞাপন সংস্থার ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে তৈরি হয়েছিল। তিনি বলছেন, “হোর্ডিংয়ের জন্যই ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হয়েছিল। মানুষের জন্য নয়।” তাঁর ঘোষণা, পুরসভার তরফে ফুটব্রিজ তৈরির জন্য ২০টি জায়গায় সমীক্ষা হয়েছে। প্রতিটি ব্রিজই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এসকালেটর-সহ তৈরি হবে।
যদিও পুরসভার এক সূত্র বলেন, বাম আমলের মতো এ বারও ফুটব্রিজ তৈরি হবে বিজ্ঞাপন সংস্থা ও পুরসভার যৌথ উদ্যোগে (পিপিপি মডেলে)। নতুন ফুটব্রিজগুলি কাঁকুড়গাছি বা রাজাবাজারের মতো হবে না তো? প্রশ্নটা রয়েই যাচ্ছে। |