ব্যবসার কাজে ফি সপ্তাহে কলকাতা যাতায়াত করতে হয় ডুয়ার্সের রফিকুল শেখ, নীরেন রায়দের। মূলত ট্রেনেই মালপত্র আনেন ওঁরা। পণ্য মাসুল ও দূরপাল্লার ট্রেনে টিকিটের সারচার্জ বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করলেও মুষড়ে পড়েননি ওঁরা কেউই। বরং, বাড়তি ভাড়া গোনার পরে ট্রেনে পরিষেবার মান বাড়বে কি না সেই প্রশ্নেই বেশি উদ্বিগ্ন তাঁরা। এমনকী, যে চিকিৎসকেরা মাসে একাধিকবার কলকাতা যাতায়াত করে থাকেন, তাঁদের অনেকের কথায় ধরা পড়েছে একই সুর। প্রায় সকলেরই বক্তব্য, “বাড়তি ভাড়া দেওয়ার পরে যেন ট্রেনে সুষ্ঠু পরিষেবা মেলে। যেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়।”
পাশাপাশি, উত্তরের পাহাড় ও সমতলের নানা এলাকায় ইতিমধ্যেই যে সব রেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, তার কাজ মসৃণ গতিতে এগোবে কি না তা নিয়েও চলছে জল্পনা। যেমন, বুনিয়াদপুরে রেলের কামরা তৈরির কারখানার শিলান্যাস হয়েছে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর। ২৫ একর জমিতে প্রায় ১৩৫ কোটি টাকায় প্রকল্পটি হওয়ার কথা। একই ভাবে নিউ জলপাইগুড়িতে রেলের অ্যাকসেল তৈরির কারখানারও শিলান্যাস হয়েছে। যেখানে প্রথম পর্যায়ে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ওই দুটি কারখানার কাজে চলতি বাজেটে কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। রেল সূত্রের খবর, বাজেটে পুরানো প্রকল্পগুলির কোনটি বাতিল কিংবা স্থগিত রাখা হয়নি। ফলে, তা নিয়ে আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। |
উত্তরবঙ্গের প্রাপ্তি, প্রশ্ন |
• নতুন ট্রেন |
• হাওড়া থেকে এনজেপি এসি এক্সপ্রেস ভায়া মালদহ টাউন (সাপ্তাহিক)
• রাধিকাপুর থেকে আনন্দবিহার লিঙ্ক এক্সপ্রেস (প্রতিদিন)
• যোধপুর থেকে কামাখ্যা এক্সপ্রেস (সাপ্তাহিক)
• কামাখ্যা থেকে আনন্দবিহার এক্সপ্রেস (সাপ্তাহিক)
• কামাখ্যা থেকে বেঙ্গালুরু এসি এক্সপ্রেস (সাপ্তাহিক)
• কাটিহার থেকে হাওড়া ভায়া মালদহ টাউন এক্সপ্রেস (সাপ্তাহিক)
• রাজেন্দ্রনগর টার্মিনাস (পটনা) থেকে নিউ তিনসুকিয়া এক্সপ্রেস (সাপ্তাহিক)
|
• ডবল লাইন |
• আমবাড়ি-ফালাকাটা-বেলাকোবা
• বেলাকোবা-রানিনগর- জলপাইগুড়ি রোড
• নিউ আলিপুরদুয়ার-শামুকতলা
• নিউ কোচবিহার- বাণেশ্বর
|
• নতুন লাইন |
• চ্যাংরাবান্ধা-নিউ কোচবিহার ওয়াই লাইন
•
ময়নাগুড়ি রোড-নিউ ময়নাগুড়ি-নিউ দোমহনি
|
• যাত্রাপথ বৃদ্ধি |
এনজেপি-আজমেড় এক্সপ্রেস উদয়পুর অবধি। আজমেঢ়-কিসানগঞ্জ এক্সপ্রেস এনজেপি অবধি। গুয়াহাটি-এনারাকুলাম এক্সপ্রেস তিরুঅনন্তপুরম অবধি। লালগড়-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস নিউ তিনসুকিয়া অবধি। নিউ দিল্লি-নিউ ফরাক্কা এক্সপ্রেস মালদহ টাউন অবধি। এনজেপি-দ্বারভাঙা এক্সপ্রেস সিতামারি অবধি।
|
• দিন বাড়ানো |
হাওড়া-মালদহ এক্সপ্রেস, ছয় দিনের পরিবর্তে সাত দিন। মালদহ-জামালপুর এক্সপ্রেস, ছয় দিনের পরিবর্তে সাত দিন।
|
• যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল |
• নিউ জলপাইগুড়িতে রেলের অ্যাকসেল তৈরির কারখানার কী হবে?
• বুনিয়াদপুরে ওয়াগান তৈরির কারখানার জন্য চলতি বাজেটে বরাদ্দ কত?
|
|
নতুন ট্রেন চালু কিংবা ডবল লাইন করানো অথবা পুরানো দূরপাল্লার ট্রেনগুলির যাত্রাপথ সম্প্রসারণের ব্যাপারে ছয় জেলায় অনেক দাবি থাকলেও বাস্তবে কতটা পূরণ হয়েছে তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। এবারের বাজেটে উত্তরবঙ্গ থেকে ৬টি নতুন সাপ্তাহিক এক্সপ্রেস ট্রেন চালুর ঘোষণা হয়েছে। ৬টি ট্রেনের যাত্রাপথ সম্প্রসারিত হয়েছে। জলপাইগুড়ি ও ডুয়ার্সে ডবল লাইন করানোর উল্লেখও রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির চেয়ারম্যান গৌতম দেবের বক্তব্য, “সামগ্রিক ভাবে উত্তরবঙ্গবাসীর পক্ষে অত্যন্ত হতাশার রেল বাজেট।” তাঁর অভিযোগ, কংগ্রেস আমলে উত্তরবঙ্গকে বঞ্চনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখল এবারের রেল বাজেট। পুরানো প্রকল্প গুলির কী হবে তার কোনও স্পষ্ট দিশাই দেখানো হয়নি বাজেটে।” শীঘ্রই প্রতিবাদে ‘মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামা হবে’ বলেও জানিয়ে দিয়েছেন গৌতমবাবু।
যদিও কংগ্রেসের বিধায়ক শঙ্কর মালাকার, মোহিত সেনগুপ্তরা মনে করেন, ঢালাও ঘোষণার পথে না-হেঁটে স্পষ্ট দিশার বাজেট উপহার দিয়েছেন রেলমন্ত্রী। রায়গঞ্জের বিধায়ক মোহিতবাবু বলেন, “অত্যন্ত গতিশীল রেল বাজেট। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর কাছে রাধিকাপুর দিল্লিগামী ট্রেনটিকে প্রতি দিন চালানোর দাবি জানিয়ে ছিলাম। রেল বাজেটে দাবি পূরণ হওয়ায় খুশি। আশা করছি, রেলমন্ত্রক খুব শীঘ্রই জেলাবাসীর সমস্ত দাবি পূরণ করবে।”
মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক শঙ্করবাবু বলেন, “রেল বাজেটে উত্তরবঙ্গের সব জেলার কথাই ভাবা হয়েছে। ভাল করে খতিয়ে দেখলে সেটাই স্পষ্ট হয়। একগাদা ঘোষণা করে বেশির ভাগ কাজ করতে না-পারাটা মানুষ ভাল ভাবে নেন না।” সিপিএমের দার্জিলিং জেলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জীবেশ সরকারও এবারের রেল বাজেটে আগের দুটো বছরের মতো বিস্তর প্রতিশ্রুতি, কথার ফুলঝুরি নেই বলে মন্তব্য করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “আগের দুটো রেল বাজেটে কথার ফুলঝুরি ছিল। কাজের কাজ হয়নি। এবার প্রতিশ্রুতি নেই। সেটা একদিক থেকে ভাল। তবে উত্তরবঙ্গের ভাঁড়ার কার্যত শূন্য রয়ে গেল। ভাল করে রেল বাজেটটা দেখে বিশদে বলব।”
দার্জিলিং পাহাড়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা অবশ্য রেল বাজেট নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চায়নি। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিনয় তামাং বলেন, “আমরা রেল বাজেট নিয়ে দলীয় ভাবে আলোচনা করব। তার পরেই যা বলার বলব।” উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ী মহল অবশ্য পুরানো প্রকল্পগুলির জন্য কী পরিমাণ বরাদ্দ হল সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, নর্থ বেঙ্গল (ফোসিন) -এর সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, “সিকিমের রংপো পর্যন্ত রেল পথের কী হবে? এনজেপি-র অ্যাক্সেল কারখানার কাজ কবে পুরোদমে শুরু হবে? এ সব নিয়ে বিশদে খোঁজ নিতে হবে।”এর পাশাপাশি, সিআইআই-র উত্তরবঙ্গ শাখার অন্যতম সদস্য সুজিত রাহাও এই দিন পুরানো রেল প্রকল্পগুলি নিয়ে দুশ্চিন্তার অবকাশ রয়েই যাচ্ছে বলে মনে করেন।
তবে এবারের রেল বাজেটে হাতির সঙ্গে ট্রেনের সংঘাত রুখতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা রেলমন্ত্রী ঘোষণা করায় স্বস্তিতে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণ প্রেমীরা। রাজাভাতখাওয়ার বাসিন্দা তথা বন ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষা মঞ্চের অহ্বায়ক গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে বলেন, “ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যু রুখতে রেল মন্ত্রী পদক্ষেপ নেওয়ায় কথা বলায় আমরা খুশি। আশা করছি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |