বছরভর কাজের জন্য বরাদ্দ ছিল যে টাকা, শেষ বেলায় এসে তা এক দিনেই খরচ করতে হচ্ছে। এবং এমন ভাবে, যাতে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে যে, তাতে কাজের কাজ আদৌ কিছু হবে কি না।
গ্রামাঞ্চলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য-পরিষেবায় নিয়োজিত আশা-কর্মীদের (অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট) বিভিন্ন কর্মসূচি খাতে ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গকে ৫০ লক্ষ টাকা দিয়েছিল কেন্দ্র। সারা বছরে কর্মসূচি বলতে বিশেষ কিছু হয়নি। তাই টাকাও পড়ে আছে যেমন-কে-তেমন। অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার মুখে এখন তা ফেরত যাওয়ার উপক্রম। শেষ মুহূর্তে রাজ্যের টনক নড়েছে। তড়িঘড়ি খরচের একটা উপায় বার করেছে স্বাস্থ্য দফতর। কী উপায়?
ঠিক হয়েছে, গোটা রাজ্যের দশ হাজার আশা-কর্মীকে কলকাতায় এনে এক বেলার ‘রাজ্য সম্মেলন’ করা হবে। তাতেই খরচ হয়ে যাবে বরাদ্দের ওই আধ কোটি। |
আজ, বুধবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সম্মেলনটি হওয়ার কথা। কিন্তু এই আয়োজনের পিছনে দায় সারার মনোভাব দেখছেন স্বাস্থ্য-কর্তাদেরই একাংশ। যাঁদের বক্তব্য: টাকাটা দিয়ে সারা বছর জুড়ে বিভিন্ন সদর্থক কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল। তার বদলে বছরশেষে এক বেলার সম্মেলন করলে বরাদ্দের আসল উদ্দেশ্য কতটা সিদ্ধ হবে?
গ্রামে-গঞ্জে গর্ভবতী-প্রসূতি-সদ্যোজাতদের স্বাস্থ্যরক্ষার কাজ করেন আশা-কর্মীরা। গর্ভবতীর নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব নিশ্চিত করার ভার মূলত এই মহিলা-বাহিনীর উপরে। শিশুর টিকাকরণ, মানুষকে বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে সচেতন করাও ওঁদের দায়িত্বের অঙ্গ। স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য: জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন (এনআরএইচএম)-এ কেন্দ্র চলতি অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে ‘আশা রিসোর্স সেন্টার ও আশা মেন্টরিং গ্রুপ’ বাবদ প্রায় আট কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। তার ৫০ লক্ষ টাকা ধরা রয়েছে বছরভর আশা-কর্মীদের সচেতনতা বৈঠক আয়োজন, দু’-তিন মাস অন্তর কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা, ভিডিও কনফারেন্সিং ও আশা দিবস পালন সংক্রান্ত উপ-খাতে। বছর ঘুরতে চললেও যার প্রায় কোনওটাই বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ।
ফলে ৫০ লক্ষ টাকা পড়েই রয়েছে। মার্চের মধ্যে খরচ না-হলে তা দিল্লিতে ফেরত যাবে। অতএব নেতাজি ইন্ডোরে সম্মেলনের পরিকল্পনা। “বরাদ্দ ফেরত গেলে নানা কথা হতো। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতেন। তাই যে ভাবে হোক, খরচ করে ফেলা হচ্ছে।” আক্ষেপ এক স্বাস্থ্য-কর্তার। সম্মেলন উপলক্ষ্যে ইন্ডোরের এলাহি আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁর মন্তব্য, “গ্রাম-গঞ্জের আশা-কর্মীদের কাজে উৎসাহ বাড়াতে বছরে এক বার তাঁদের কলকাতায় নিয়ে এসে অনুষ্ঠান করা যেতেই পারে। কিন্তু অন্য কোনও কাজ হল না, শুধু জাঁকজমকের সম্মেলনেই সবটা বেরিয়ে গেল মানা যায় না।” |
কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ দিয়ে কী আয়োজন হচ্ছে?
এনআরএইচএম সূত্রের খবর: শুধু ইন্ডোর সাজাতেই যাচ্ছে ২০-২২ লক্ষ। এ ছাড়া আশা-কর্মীদের আনা-নেওয়ার জন্য শ’তিনেক বাস ভাড়া করা হচ্ছে। সল্টলেক স্টেডিয়ামে তাঁদের রাখা হবে, সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত। সব মিলিয়ে সম্মেলনের বাজেট ৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রে বাড়তি অর্থের সংস্থান হবে এনআরএইচএমের ‘প্রচার’ খাতে বরাদ্দ থেকে, যার সাকুল্যে ৩% খরচ করতে পেরেছে রাজ্য। এই মওকায় প্রচার খাতের অব্যবহৃত বরাদ্দও খরচ করে ফেলার একটা চেষ্টা চলছে বলে স্বাস্থ্য দফতরের একটি মহলের দাবি।
শুনে কেন্দ্রের স্বাস্থ্য-কর্তারা কী বলছেন?
এনআরএইচএমের মিশন-অধিকর্তা সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ বলেন, “আশা-কর্মীদের সচেতনতা কর্মসূচি, কাজকর্ম পর্যালোচনা বা আশা দিবস পালন এ বছরে রাজ্যে যে কিছু করা হয়নি, তা তো আমি জানতামই না!” প্রকল্পের এক কর্তার মতে, “যে উদ্দেশ্যে টাকা দেওয়া, সেটাই তো ব্যর্থ! গ্রামাঞ্চলে মা-শিশুর স্বাস্থ্যের মূল দায়িত্ব যাঁদের হাতে, তাঁদের কাজের পর্যালোচনা হল না। জানা গেল না, কোথায় কোন কাজ হচ্ছে না, কিংবা কোথায় আরও কী হওয়া দরকার। এতে নতুন পরিকল্পনা মার খাবে। আখেরে ক্ষতি হবে গ্রামের মানুষেরই।”
রাজ্য সরকার কি তা মানছে?
সরকারের বক্তব্যে তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই। বরং রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলছেন, “সারা বছর ধরে ব্লকে-ব্লকে আশাদের নিয়ে সম্মেলন-সেমিনার করতে হবে, এমন নিয়ম কেউ ঠিক করে দেয়নি। একটা অনুষ্ঠান করব নাকি হাজারটা, সেটা আমাদের ব্যাপার। টাকা খরচ হলেই হল।” |