নায়কের নাম ক্যামেরা! লন্ডন হোক বা মুম্বই, জঙ্গি হামলার তদন্তে কেল্লা ফতে ক্লোজড-সার্কিট টিভি ক্যামেরার দৌলতেই। আর ক্যামেরা অকেজো থাকলে কী দশা হয়, তার ভুরি ভুরি নমুনা কলকাতায়। রাতের শহরে সকলের অলক্ষ্যে মহাকরণের সামনে যুবক মারা গেলেও অঘটনের রহস্য সমাধানে লালবাজারকে মাথা খুঁড়তে হয়।
পরিস্থিতি পাল্টাতে অবশেষে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে রাজ্য প্রশাসন। স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা আর মাসখানেক ধৈর্য ধরতে বলছেন। তাঁদের আশ্বাস, নিরাপত্তা মজবুত করতে শীঘ্রই কলকাতায় নজরদারির পূর্ণাঙ্গ ক্যামেরা-পরিকাঠামো গড়ে উঠবে। মহাকরণ সূত্রের খবর, কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগে ৮-৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এক মাসের মধ্যেই শহরের ১৫০টি জায়গায় ৪০০টি ক্যামেরা বসানো হবে। প্রযুক্তির প্রয়োগ বা ফুটেজের বৈশিষ্ট্যে নতুন ক্যামেরাগুলি এ শহরে বেনজির বলেই জানাচ্ছেন সরকারি কর্তারা।
কলকাতার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দেবাশিস রায় বলেন, “নতুন এই প্রকল্পের নাম ইন্টেলিজেন্ট সার্ভিল্যান্স সিস্টেম (আইএসএস)। এই ব্যবস্থায় কোনও ঘটনা ঘটার পরে ক্যামেরায় ওঠা ছবির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের সুযোগ থাকবে।’’ পুলিশি তদন্তের স্বার্থে অন্তত এক মাস ফুটেজ সংরক্ষণ করা যাবে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তারা।
২০০৫ সালের লন্ডনে মেট্রোয় বিস্ফোরণে দোষীদের ক্যামেরার ‘ফুটেজ’ থেকেই চিহ্নিত করা হয়। মুম্বইয়ের ২৬/১১-র হামলাতেও আজমল কসাবের বিরুদ্ধে অকাট্য তথ্যপ্রমাণ হিসেবে উঠে আসে ক্যামেরার ‘ফুটেজ’। হায়দরাবাদের দিলসুখনগরে বিস্ফোরণের টাটকা ঘটনাটির পরেও ওই জায়গায় সিসিটিভি-র ছবি ঘেঁটেই তদন্তে নেমেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। আর কলকাতাতেও সঙ্গে-সঙ্গে আইএসএস প্রকল্প রূপায়ণের কাজে গতি বাড়িয়েছেন লালবাজারের কর্তারা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকা জরিপ করে ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরুও হয়ে গিয়েছে। |
কী ভাবে কাজ করবে নজরদারির নতুন ব্যবস্থা?
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, “৪০০টি ক্যামেরার ছবিতে নজরদারি চালানো মুখের কথা নয়। তাই লালবাজারের মূল কন্ট্রোল রুম ও ট্রাফিক কন্ট্রোলরুম ছাড়াও শহরের বিভিন্ন ডিসি অফিস ও ট্রাফিক গার্ডগুলিতে এলাকা-ভিত্তিক কন্ট্রোলরুম তৈরি হবে।” এর ফলে, ক্যামেরা-বসানো সবক’টি এলাকায় সমান নজরদারি চালানো যাবে বলে মনে করছেন পুলিশকর্তারা। লালবাজারের বিভিন্ন স্তরের কর্তারা মিলে আলোচনা করেই শহরের কোথায় ক’টি ক্যামেরা বসবে, তা ঠিক করা হচ্ছে।
উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করলেও অভিজ্ঞতার নিরিখে কিছুটা সতর্ক লালবাজারের কর্তারা। কয়েক বছর আগে শহরের কোথাও কোনও অপরাধের চটজলদি মোকাবিলায় জিআইএস মানচিত্রের সাহায্য নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। কন্ট্রোলরুমে সাহায্য চেয়ে কেউ ফোন করলেই ওই মানচিত্রের মাধ্যমে কোথায় ঘটনাটি ঘটেছে, তা চিহ্নিত করে নিকটবর্তী পুলিশকে জানানোর ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা হয়। কিন্তু কলকাতার রাস্তা বা রাজপথে যানবাহনের রকমফের এই প্রযুক্তির জন্য উপযুক্ত নয় বলেই প্রমাণ হয়েছিল। ফলে, ব্যয়বহুল প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আইএসএস প্রকল্পটিকে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বেশি জটিল করার পক্ষপাতী নন পুলিশকর্তারা।
পদ্ধতিগত জটিলতায় কিছুটা টালবাহানার পরে কলকাতার একটি সংস্থাকেই প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন ক্যামেরা রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিও বড় মাথাব্যথা বলে মানছেন পুলিশকর্তারা। কারণ, কলকাতায় আগে বসানো ক্যামেরাগুলির বেশির ভাগই নানা প্রযুক্তিগত জটিলতায় অকেজো। এখন সাকুল্যে ১৫-১৬টি ক্যামেরায় গুটিকয়েক এলাকায় নজরদারি চালানো হচ্ছে। এই ব্যবস্থায় মূলত যানজট সামলানো হয়। বড়জোর দিনের কয়েক ঘণ্টা লালবাজারে বসে ছবি ‘জুম’ করে সিগন্যাল লঙ্ঘন করা গাড়িগুলি চিহ্নিত করা হয়।
এ শহরে গত বছর পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণ-কাণ্ডের পরে অভিযুক্তদের চিনতে ওই তল্লাটের নাইট ক্লাবের সিসিটিভি-র ফুটেজের শরণাপন্ন হন লালবাজারের কর্তারা। ক’দিন আগে গার্ডেনরিচে পুলিশ অফিসার খুনের ঘটনাতেও সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরাতেই আততায়ী চিহ্নিত হয়ে যায়। নতুন প্রকল্পের নজরদার-ক্যামেরা বসলে এমন অনেক তদন্ত সহজ হয়ে যাবে বলে আশা লালবাজারের কর্তাদের। |