হয়েতা অস্কারের জন্য

“ভারতীয়রা সব চেয়ে খারাপ সিনেমাগুলোকে অস্কারে পাঠায়। বলিউডি সিনেমা অস্কারে পাঠানো বন্ধ করা উচিত। ওগুলো অস্কার পাওয়ার মতো নয়। সিনেমাগুলো ক্লিশেতে ভর্তি... সব চেয়ে ভাল হয় এমন ছবি পাঠানো যেগুলো সুস্থ রুচির পরিচয় দেয়, ভারতীয় প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বেশ মানানসই এবং যেগুলোর মধ্যে দিয়ে স্বাধীন চিন্তাভাবনা প্রকাশ পায়। যদি এগুলো করা হয়, তা হলেই ভারত একটা অস্কার পাবে।”

ডেরেক ম্যালকম,
প্রেসিডেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন

গত বছর গোয়ার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এমনই এক বক্তব্য রেখেছিলেন ডেরেক ম্যালকম। কেউ কেউ হয়তো বলবেন খুবই কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। কেউ আবার বলবেন যে ভারতীয় ছবিকে আয়নার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। যদি সাম্প্রতিক কালের ভারতীয় ছবির ইতিহাস দেখা যায়, তা হলে এ কথা ঠিক যে আমাদের সিনেমা অস্কার দৌড়ে অনেক পিছিয়ে। আর এর সঙ্গে ভারত বা ভারতীয় অভিনেতাদের কোনও সম্পর্কই নেই। আমাদের অভিনেতারা অস্কার বিজয়ী ছবিও করেছেন। যেমন ‘লাইফ অব পাই’ বা ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’। ভারতে তৈরি ছবি ভারতীয়দের নিয়ে। অস্কার এসেছে ঘরে, তবে অনেকেই বলছেন তা প্রতিফলিত গৌরবের জোরেই।
তা হলে কোথায় খামতি থাকছে?
উদাহরণ হিসেবে ‘লাইফ অব পাই’-এর কথাই বলা যেতে পারে। অনেকেই জানেন না যে পরিচালক অ্যাং লি ইয়ান মার্টেলের চরিত্রটা করিয়েছিলেন ‘স্পাইডারম্যান’ চরিত্রাভিনেতা টবি ম্যাগুয়েরকে দিয়ে। কিন্তু শু্যটিংয়ের মাস ছ’য়েক বাদে পরিচালকের হঠাৎ মনে হয় ‘স্পাইডারম্যানের’ ইমেজটা টবির সঙ্গে যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি মার্টেলের চরিত্রের জন্য এমন এক অভিনেতাকে চাইছিলেন যাঁর সঙ্গে কোনও ইমেজ জড়িয়ে নেই। সিনেমাতে মার্টেলের চরিত্রটি এক উঠতি লেখকের। তাই ইমেজওয়ালা কোনও নামজাদা অভিনেতা কখনওই ওই চরিত্রের সঙ্গে মানানসই হতে পারেন না। সুতরাং অ্যাং বেছে নিলেন অভিনেতা রেফ স্প্যালকে। ইরফান যখন দ্বিতীয়বার শু্যট করতে লস অ্যাঞ্জেলেস যান, তিনি ঠিক করে নেন যে টুকরোটাকরার মধ্যে না গিয়ে গোটা অংশটাই পুনরায় শু্যট করবেন। এবং সেটাই করেছিলেন অ্যাং। ঘটনাক্রমে অনেকেরই মনে হয়েছে যে ছবির নাটকীয় মোড় যেন লুকিয়ে রয়েছে ইরফানের সঙ্গে রেফের অভিনীত দৃশ্যগুলোতেই।

গত ছ’বছরের অস্কারে পাঠানো ভারতীয় ছবি
২০১২ বরফি ২০১১ আদামিন্তে মাকন আবু

তবে এ কথা ঠিক যে এ বছর অ্যাং-এর সেরা পরিচালকের অস্কার জেতার কারণ কিন্তু শুধু এটাই নয়। কিন্তু একজন অস্কার বিজয়ী পরিচালক ঠিক কী ভাবে দেখেন বা ভাবেন তা এই ঘটনা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। ছিদ্রান্বেষীরা অবশ্য বলবেন যে এই সব করার পেছনে অনেক টাকার গল্প আছে। আর টবির মতো এমন বিশাল এক তারকাকে সরিয়ে এক অনামা অভিনেতাকে দিয়ে অভিনয় করানোর মধ্যে যথেষ্ট সাহসিকতাও দরকার। এবং দ্বিতীয়বার গোটাটা অভিনয় করানোটাও সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু শুধু পয়সা বা সাহস থাকলেই এটা করা যায় না। একটা বিশেষ ঘরানার সিনেমা বানানোর মানসিকতা থাকা খুব দরকার। আর সেই সিনেমাটা যাতে হয়, সেটা সুনিশ্চিত করাটা আরও বেশি প্রয়োজনীয়। আর অ্যাং সেটাই করেছেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যেও কি একই বিশ্বাস কাজ করে? আর তা থাকা বা না-থাকাটাই কি আমাদের ছবিকে অস্কারে ব্রাত্য করছে?

অস্কারের মতো পশ্চিমী পৃষ্ঠপোষকতার কি প্রয়োজন?
এই প্রশ্নটাই এখন অনেককে ভাবাচ্ছে। ১৯৮৪তে মহেশ ভট্ট পরিচালিত ‘সারাংশ’ সিনেমাটি অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিল। মহেশ ভট্টকে জিজ্ঞেস করা হয় অস্কারে মনোনয়ন পাওয়ার মতো এমন কী ছিল ‘সারাংশ’-এ? আর এখনকার সিনেমাগুলোর মধ্যে কেন সেই ব্যাপারটা নেই? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, “তখনও কিছু যায় আসেনি, আর এখনও কিছুই যায় আসে না। আমার ছবি বিক্রিতে বড়সড় কোনও তফাত হয়নি।”
আরও বলেন, অস্কারে সত্যজিৎ রায়ের ‘লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়াটা ওঁর স্টেচারের সঙ্গে আলাদা করে কিছু যোগ করেনি। “ওঁর গুণমুগ্ধরা তো বলেন, ওই অ্যাওয়ার্ডটা না কি ওঁকে খানিকটা ‘খাটো’ করেছে। সত্যজিৎ রায় কিন্তু খ্যাতির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বল করছেন। অস্কারের মতো একটা বিশাল মাপের প্রচার অনুষ্ঠান ওঁকে যেন গিলে খেতে চেয়েছিল। হলিউডে যে ধরনের সিনেমা তৈরি হয়, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার ঘরানা তার থেকে পুরোপুরি আলাদা। ওঁর অস্কারের কোনও প্রয়োজন ছিল না। অস্কারওয়ালাদের প্রয়োজন ছিল ওঁর মতো এক ব্যক্তিত্বের,” মহেশ বলেন।
এখনকার ভারতীয় পরিচালকদের সঙ্গেও কি এ রকমটা ঘটে? “অস্কার না পেলে জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে, এমন কোনও পরিচালক আছেন বলে আমি অন্তত জানি না। সার কথা হল এখনও পর্যন্ত অস্কার ম্যানিয়াটা আমাদের সে ভাবে কাবু করতে পারেনি। তবে যাঁরা অস্কার পেতে চান, তাঁদের সম্পর্কে আমার বলার কিছুই নেই। আমি মাংস খাই না। তাই কসাইখানাতেও যাই না,” জোর গলায় বলেন মহেশ।
সানফ্রান্সিসকোতে বসে পরিচালক অসীম অহলুওয়ালিয়ারও মত একই। তাঁর ছবি ‘মিস লাভলি’ গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতায় ছিল ‘আঁ স্যারত্যঁ রগার’ বিভাগে। “অস্কার আমেরিকার স্টুডিয়ো ছবিগুলোর জন্য তৈরি। ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। এটা একটা আমেরিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ইভেন্ট যেখানে হলিউড নিজেকেই পুরস্কৃত করে।
যে জায়গাটা আমাদের জন্য নয়, সেখানে পৌঁছনো নিয়ে এত মাথাব্যথা কীসের?” সানফ্রান্সিসকোতে বসে প্রশ্ন করেন অসীম।
অস্কারের প্রতি এ রকম একটা উদাসীন মনোভাব বহু ভারতীয় পরিচালকের মধ্যেই রয়েছে। তাঁরা মনে করেন শুধুমাত্র একটা ভাল ছবি বানালেই অস্কার জেতা যায় না। সিনেমার অন্তর্নিহিত সত্তার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল স্টুডিয়োর সহযোগিতা, দুনিয়া জুড়ে সেই ছবির বিপণন এবং ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ। তাঁদের মতে যদি পরিচালকদের এই বিশেষ ক্ষমতাগুলো না থাকে, তা হলে যত ভাল ছবিই হোক, অস্কার কমিটির নজরে পড়বে না। তাই ছটফট করে কোনও লাভ নেই।

গত ছ’বছরের অস্কারে পাঠানো ভারতীয় ছবি
২০১০ পিপলি লাইভ ২০০৯ হরিশচন্দ্রাচি ফ্যাক্টরি

বলিউড অস্কারে গ্রহণযোগ্য হওয়ার মতো ছবি বানায় না

তবে অনেকেই এ রকম উদাসীন নন। দুর্ভাগ্যবশত কিছু ক্ষেত্রে বলিউডের হিন্দি ছবি ভারতীয় সিনেমার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দেশে বলিউডের সিনেমা নিয়ে পুরস্কার অনুষ্ঠানগুলোতে যতই নাচানাচি হোক, ওয়ার্ল্ড সিনেমার সঙ্গে তা কোনও মতেই খাপ খায় না। এই কিছু দিন আগেই ‘ধোবি ঘাট’ সিনেমার পরিচালক কিরণ রাও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমাদের সিনেমার ব্যাকরণ আলাদা। তাই পৃথিবীর দর্শকদের মনে আলোড়ন ফেলে দিতে পারে এমন সিনেমা এখানে হাতে গুনে মেলে। এটা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য অ্যাকাডেমির দর্শকদের ব্যাপারে। কিরণের মতে আমাদের সিনেমার ভাষা পশ্চিমের সিনেমার ভাষার থেকে একেবারেই ভিন্ন। আবেগের ব্যাপারেও তাই। অস্কার বিজয়ী সিনেমার নিরিখে এই ধরনের আবেগ একেবারেই মানানসই নয়।

দৃঢ় প্রতিজ্ঞা না টাকা?
‘লাইফ অব পাই’ সিনেমার অভিনেতা আদিল হুসেন বলছেন অস্কারের কাছকাছি পৌঁছতে গেলে ভাল সিনেমা এবং ভাল চিত্রনাট্যের পাশাপাশি প্রচুর পরিশ্রমও করতে হবে। “অস্কারে আমরা যে ছবিগুলো পাঠাচ্ছি সেগুলো মোটেই বিশ্বমানের নয়। একটা দারুণ চিত্রনাট্য নিয়ে আমাদের অনেক খাটতে হবে। শুধু টাকার কথা ভাবলে চলবে না। ভারতে তো বেশির ভাগ সময়ই শিল্পের উদ্দেশ্যের চাইতে ব্যবসাকেই বড় করে দেখার রেওয়াজ আছে,” বলেন আদিল।
ইরফানকে নিয়ে অ্যাং যে ভাবে নতুন করে সিনেমার শু্যটিং করতে চেয়েছিলেন, সেই উদাহরণ তুলে ধরে আদিল আবারও বললেন, ‘‘ভাল করার সেই স্পৃহাটাই তো এখানে দেখতে পাই না। ১০০-কোটি ক্লাবের কাছে টাকাপয়সা কোনও সমস্যাই হতে পারে না। তবে ইচ্ছেটা কই?”

আমাদের সিনেমা ওদের সিনেমা
২০০৪-এ অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিল পরিচালক সন্দীপ সাওয়ন্ত-এর মরাঠি সিনেমা ‘শ্বাস’। সন্দীপের মতে ভারতীয় সিনেমায় বিনোদনের সংজ্ঞা ওয়ার্ল্ড সিনেমার থেকে একেবারেই আলাদা। “আমরা বিনোদনের দিকটাকেই বেশি প্রাধান্য দিই। আর অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্রকারদের থেকে আমাদের বিনোদনের সংজ্ঞা পুরোপুরি আলাদা। কারিগরি দক্ষতার কারণে যে সব ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা একটু অন্য রকমের হয় সেগুলো ভারতীয় দর্শকদের কিছুটা নাড়া দেয়। তবে জেনে রাখা ভাল যে সেই সিনেমাগুলোয় যে ধরনের কারিগরি কৌশল থাকে সেটা কিন্তু পশ্চিমী সিনেমার জগতে অজানা নয়। গে রাইটস নিয়ে আমরা সবে ছবি তৈরি করতে শুরু করেছি। পশ্চিমী সিনেমা বহু কাল ধরেই এই বিষয়ের ওপর ছবি বানিয়ে যাচ্ছে। তা হলে অস্কারের মঞ্চে এ নিয়ে বিস্ময়টা কোথায়?” জিজ্ঞাসা করেন সন্দীপ।

গত ছ’বছরের অস্কারে পাঠানো ভারতীয় ছবি
২০০৮ তারে জমিন পর ২০০৭ একলব্য

নিউ এজ ইন্ডি সিনেমার কী হাল?

অস্কারের তুলনায় বলিউড বস্তাপচা হলেও, নিউ এজ ইন্ডি চলচ্চিত্রের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ছে না কেন? বা আঞ্চলিক সিনেমার? না কি জুরিদের পছন্দের ব্যাপারটাও বলিউডের ক্ষমতাশালীরাই নিয়ন্ত্রণ করেন! ভারতীয় চলচ্চিত্রে নতুন ধারার, মুক্ত চিন্তাভাবনার ছবি তৈরি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের তাবড় সমস্ত সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতার দৌড়ে কেন এদের কোথাও সে ভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না? অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ী হালফিল এই ধরনের কিছু সিনেমা করেছেন। মনোজ বললেন, “ইনডিপেন্ডেন্ট সিনেমা তো আছেই। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ব্যবসাকে এতটাই গুরুত্ব দেয় যে এই ধরনের সিনেমা হিট না হলে ওদের নজরেই পড়ে না। দর্শকরাও এতটাই ঝানু যে যদি প্রচার বা বিপণন ভাল না হয়, তা হলে তাঁরাও এই ধরনের সিনেমা দেখেন না। ‘পেডলারস’, ‘আন্হে ঘোড়্হে দা দান’ এবং আরও বেশ কিছু আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা হয়েছে যেগুলো দেখা দরকার। ওগুলো যথেষ্ট প্রশংসার দাবিও রাখে। দুর্ভাগ্যবশত এরা প্রচার পায় না। আর কেউ দেখেও না। আঞ্চলিক সিনেমাও কিন্তু সমান সম্মানের দাবিদার। ভারতীয় সিনেমারই অংশ এরা।” মনোজ কি মনে করেন যে ‘গ্যাংস অব ওয়াসেপুর’ অস্কারে যাওয়ার মতো ছবি? “প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে সিনেমাটা। কাজেই অস্কারের যোগ্য হওয়ার মতো সব কিছুই এই সিনেমাটার ভিতর রয়েছে।” কিন্তু অস্কার মনোনয়ন তো পায়নি ছবিটা? তা হলে কি সমস্যাটা অস্কারে পাঠানো ছবিগুলোর বাছাই নিয়ে? এর উত্তরে মনোজ বলেন, “জুরিরা কী ছবি বাছবেন সেই নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য রাখা ঠিক নয়।”

আমরা কি ঠিকঠাক সিনেমা পাঠাচ্ছি না?
মনোজ হয়তো এড়িয়ে গেলেন। তবে অস্কার বিজয়ী সাউন্ড ডিজাইনার রেসুল পুকুট্টি (‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’ সিনেমার জন্য জিতেছিলেন) অনেক স্বতঃস্ফূর্ত। উনি কি মানেন যে আমরা ঠিক ধরনের ছবিই পাঠাচ্ছি? উত্তরে বললেন, “আমি তো না-ই বলব। যে ছবিগুলো আমরা বাছাই করে পাঠাই সেগুলো একেবারেই নিম্ন মানের। ইরানের দিকে তাকিয়ে দেখুন। উচ্চ মানের সিনেমা তৈরি করে ওয়ার্ল্ড সিনেমার জগতে রাজত্ব করছে দেশটা। সিনেমার বাজেটটাও কোনও বড় ব্যাপার নয়! ইরানি ছবিগুলোর মতো আমাদেরও ভারি সুন্দর আঞ্চলিক ছবি রয়েছে। আমাদের বাছাই করা আজেবাজে ছবির চাইতে অস্কারে ওদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি।” ওয়ার্ল্ড প্যানোরামায় আমাদের সিনেমার গুণমান নিয়ে কী বলবেন তিনি? “আমরা ‘আমুর’-এর মতো উচ্চ মানের সিনেমা বানানোর থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। এই সিনেমাগুলো তো আবেদনের দিক থেকে সময়কেও ছাপিয়ে যায়,” বললেন রেসুল। অভিনেত্রী সীমা বিশ্বাস ১৯৯৪ সালে শেখর কপূরের ‘ব্যান্ডিট কুইন’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। ছবিটি ভারত থেকে অস্কারের জন্য মনোনীত হলেও সেই মনোনয়ন বাতিল হয়ে গিয়েছিল। কারণ ফুলন দেবী কেস করেছিলেন। আর অ্যাকাডেমিও কোনও বিতর্কসৃষ্টিকারী ছবিকে মনোনীত করে না। “ভাল ছবি যে বানানো হচ্ছে না তা নয়। আমরা ঠিক ছবিগুলো বেছে পাঠাতে পারছি না,” সীমা বলেন।
‘লাইফ অব পাই’য়ের একটি দৃশ্যে সুরজ শর্মা
এক বহিরাগতের দৃষ্টি থেকে
১৯৮৫তে রমেশ সিপ্পি বানিয়েছিলেন ‘সাগর’। ভারত থেকে অস্কার মনোনয়ন পায় সেই ছবিটা। যদিও কোনও পুরস্কার জিততে পারেনি। স্মৃতি ঘাঁটতে গিয়ে রমেশ বললেন ভারতীয় সিনেমা এক বিশেষ ধরনের দর্শকের কথা ভেবেই বানানো হয়। “অস্কার মনোনয়ন পাবে ভেবে কিন্তু আমি ‘সাগর’ বানাইনি। আমার অনুমান অ্যাকাডেমি এমন সব ছবিই চায় যেগুলো বাস্তবের কাছাকাছি। তার মধ্যেই আবার একটা টাটকা ব্যাপার থাকা চাই। আমি যখন ভারতীয় সিনেমা অস্কারে পাঠানোর কমিটির দায়িত্বে ছিলাম, তখন বেছে নিয়েছিলাম ‘শ্বাস’ ছবিটাকে। আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল ছবিটা। যদিও অ্যাকাদেমি অতটা পছন্দ করেনি।” তার পর চলে যান ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’ বা ‘লাইফ অব পাই’-এর প্রসঙ্গে। এ আর রহমান, গুলজার, রেসুল পুকুট্টি তো ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’-এ তাঁদের কাজের জন্য অস্কার জিতলেন। বাইরে থেকে আসা এক জন পরিচালক আমাদের দেশেরই একটা বিষয়কে তাঁর সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরলেন। কিন্তু উপস্থাপনার ভঙ্গির জোরে ছবিটা পশ্চিমী দর্শকের কাছে খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে। “ভারতীয় পরিচালকদের তুলনায় এই বিদেশি পরিচালকেরা ভাল জানেন, কী ধরনের স্টাইলে ছবি বানালে দর্শকেরা সেটা দেখবে। ভারতীয় পরিচালকদের তৈরি সিনেমার বাজারটা একেবারেই আলাদা। অন্য ভাবে ছবি বানিয়ে অস্কার পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন আমাদের পরিচালকেরা। তার পর পুরস্কার জিতে ফিরে এসে ভারতীয় বাজারেও ছবিটা চালাতে পারেন। কিন্তু এর জন্য তীব্র আত্মবিশ্বাস থাকা প্রয়োজন,” রমেশ বলেন।

ডিরেক্টরস্ কাট
রমেশ সিপ্পি অনুষা রিজভি মহেশ ভট্ট

নিজেদের সিনেমা আর পুরস্কারের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন

২০১০-এ বানিয়েছেন ‘পিপলি লাইভ’। মুক্তি পাওয়া মাত্রই সাড়া ফেলে দিয়েছিল সেই সিনেমাটি। ভারত থেকে অস্কারের মনোনয়নও পেয়েছিল। পরিচালক অনুষা রিজভি অবশ্য নিজেকে সেই উন্মাদনা থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। অস্কারের প্রতি উদাসীনতা নিয়ে তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই আজও। এখন কাজ করছেন অমিতাভ ঘোষের ‘সি অব পপিজ’ বইয়ের অবলম্বনে একটি ছবিতে। “ভারতীয় ছবির অস্কার না পাওয়া নিয়ে যে সব কথা বলা হয়, তার অনেকটাই সত্যি। আমাদের বোঝা দরকার যে অ্যাকাডেমি পুরস্কারে বিদেশি ভাষার সিনেমার ক্যাটাগরিতে মাত্র একটা বিদেশি ছবি মনোনয়ন পেতে পারে। আর সেই জায়গাটা পাওয়ার জন্য দুনিয়া জুড়ে প্রতিযোগিতা। অ্যাকাডেমিতে ভাল ছবিকে পুরস্কৃত না করার ধারা তো বহু দিন ধরেই চলে আসছে। সত্যজিৎ রায় একটা লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি সিনেমাগুলো তৈরি করছিলেন তখন এই অ্যাকাডেমি কোথায় ছিল? সব সময় অ্যাকাডেমি পুরস্কার ওয়ার্ল্ড সিনেমার ভাল দিকগুলো তুলে ধরার দায়িত্ব নেয় না,” বললেন অনুষা।
এর সঙ্গে সঙ্গে অনুষা এ কথাও বললেন ভারতীয় পরিচালকেরা যদি অস্কার পেতে চান তা হলে ছবি বাছাইয়ের দিকটাও তাঁদের খুব ভাল ভাবে জানা উচিত। “পদ্ধতিটা তাঁদের জানা দরকার। অস্কারের মূল ধারার মনোনয়ন পেতে গেলে ভারতীয় ছবির আমেরিকায় মুক্তি পাওয়া প্রয়োজন। কত জনই বা এ বিষয়ে সচেতন? আর ভারতীয় সিনেমা আমেরিকায় মুক্তি পেলেও এখানকার প্রযোজকদের কি ডলারে খরচা করার মতো ট্যাঁকের জোর আছে? অস্কার মনোনয়নটাই শেষ কথা নয়। বিদেশে ছবিটার প্রচার চালাবে এমন সব এজেন্ট দরকার,” অনুষা বলেন। আরও জানান অস্কারের কথা ভুলে যান, জাতীয় পুরস্কার বেছে নেওয়ার পদ্ধতিটাও অনেকেই জানেন না। “আমরা আমাদের জাতীয় পুরস্কারকে যোগ্য সম্মান দিতে অস্বীকার করি। অস্কার নিয়ে মাতামাতিটা একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক। হতে পারে আমার কথাগুলো ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ তবু বলব অনেকেই অস্কার পেতে চান কারণ তাঁরা হলিউডের সমান উচ্চতায় পৌঁছোতে আগ্রহী। আসল কথা সাদা চামড়াটাই আমাদের টানে বেশি!”
কেউ বলছেন ধারণার অভাব। কেউ বলছেন দূরদর্শিতার। বোধ হয় বিশ্বের বৃহত্তম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অস্কারে ব্রাত্য হওয়ার বিতর্কটা চলতেই থাকবে।
সীমা বিশ্বাস আদিল হুসেন

যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ঠিকঠাক ছবি ভারত থেকে পাঠানো হচ্ছে কি না, আমি তার নেতিবাচক উত্তর দেব। যে ছবিগুলো আমরা বাছাই করে পাঠাই সেগুলো একেবারেই নিম্নমানের। ইরানের দিকে তাকিয়ে দেখুন। উচ্চমানের সিনেমা তৈরি করে ওয়ার্ল্ড সিনেমার জগতে রাজত্ব করছে দেশটা। সিনেমার বাজেটটাও কোনও বড় ব্যাপার নয়! ইরানি ছবিগুলোর মতো আমাদেরও ভারি সুন্দর আঞ্চলিক ছবি রয়েছে। আমাদের বাছাই করা আজেবাজে ছবির চাইতে অস্কারে ওদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আর ওয়ার্ল্ড সিনেমার নিরিখে আমাদের সিনেমা কোথায় দাঁড়িয়ে, এই প্রশ্নটা করলে আমার সাফ একটা জবাব আছে। আমরা ‘আমুর’-এর মতো উচ্চমানের সিনেমা বানানোর থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। এই সিনেমাগুলো তো আবেদনের দিক থেকে সময়কেও ছাপিয়ে যায়!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.