খরার স্মৃতি টাটকা। তবু পুরুলিয়া জেলার বড় জলাশয়গুলি স্রেফ সংস্কারের অভাবেই মজে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে জলধারণ ক্ষমতা। আর তার ফল ভুগছেন জেলার বাসিন্দারা। তাঁদের আক্ষেপ, নানা রকমের সরকারি প্রকল্পে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে, কিন্তু ওই জলাশয়গুলি সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেই।
কী অবস্থায় রয়েছে জলাশয়গুলি?
পুরুলিয়া-রাঁচি রাস্তার ধারে জয়পুর রেলগেট পার হলেই যে বিস্তীর্ণ জলাশয় চোখে পড়ে তা স্থানীয় মানুষজনের কাছে রানিবাঁধ নামেই পরিচিত। এলাকার প্রবীণরা জানান, এক সময় এই বাঁধের পাড়ে দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত জল দেখা যেত। গড়জয়পুর রাজবংশের অন্যতম উত্তরসূরী তথা জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শঙ্করনারায়ণ সিংহ দেও বলছিলেন,“ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রানি বিদ্যাধরীদেবী জয়পুরে এই পুকুর খনন করিয়েছিলেন। পুকুরের এক প্রান্ত ছিল জয়পুরে, অন্য প্রান্ত ছিল পাশের গ্রাম বারবেন্দ্যায়। এখন সে সব শুধুই স্মৃতি।” তিনি জানান, তখনকার সেই ১০০ একরের জলাশয় এখন কমতে কমতে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। কেন এই হাল? শঙ্করনারায়ণবাবুর কথায়, “দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়াতেই এত বড় জলাশয়ের আজ এমন দশা। রাজপরিবারের অধীনে থাকা এই বাঁধ পরে সরকার অধিগ্রহণ করে। গত ২০০৯ সালে এই পুকুর সংস্কারের কাজে হাত দেয় সরকার। ৭০ লক্ষ টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। ২৮ লক্ষ টাকার কাজ হয়। অর্থাভাবে মাঝপথে কাজ বন্ধ হয়ে যা। আর টাকা পাওয়া যায়নি।” |
শরিকি সমস্যা অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারের অন্তরায় উঠেছে। পঞ্চকোট রাজবংশের শেষ রাজধানী কাশীপুর। ওই রাজবংশের কোনও এক রাজা এখানে জমাদার বাঁধ নামে একটি জলাশয় খনন করিয়েছিলেন। কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সত্যনারায়ণ বাউরির কথায়, “আগে তো বটেই এখনও এই বাঁধ মানুষের বড় ভরসা। গ্রীষ্মকালেও এই বাঁধ শুকোয় না। কিন্তু এখন সংস্কারের অভাবই বড় সমস্যা।” স্থানীয় বাসিন্দা তথা কাশীপুর পঞ্চায়েতের সদস্য কাতির্র্ক মালাকারের কথায়, “১০০ বিঘার বেশি আয়তনের ওই বাঁধ. সংস্কারের অভাবে প্রায় অর্ধেক মজে গিয়েছে। অথচ কারও কোনও নজর নেই।” পঞ্চকোট রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য অনসুল রাজাওয়াত বলেন, “সংস্কারের খরচ অনেক। আমাদের পক্ষে ওই বাঁধ সংস্কার করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাঁধটি সংস্কার করা হলে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারত। সেচ দফতরের কাছে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু সাড়া মেলেনি।”
কাশীপুরের ধনজোড় গ্রামের কল্যাণবাঁধ বা জয়পুরের সিধিতে রাজাবাঁধদুই বড় জলাশয়ের অবস্থাও একই। দুই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিই বলছেন, “এই দুই জলাশয় শরিকি মালিকানার। তাই সংস্কারের সমস্যা রয়েছে।” একই সমস্যা নিতুড়িয়া ব্লকের গড়পঞ্চকোট পাহাড়ের আশেপাশে থাকা রামসায়র, সীতাসায়র, দেশবাঁধ, হচ্চনসায়র বা নন্দাবাঁধেরও। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এই জলাশয়গুলিরও আয়তন কমবেশি ৫০ বিঘে। এলাকায় স্নান বা নিত্য ব্যবহার্য কাজে আজও পুকুরগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু রামসায়র ছাড়া অন্য পুকুরগুলি মূলত সংস্কারের অভাবেই মজে যাচ্ছে। গড়পঞ্চকোট গ্রামের বাসিন্দা ও ধারা উন্নয়ন সমিতির সদস্য উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “পঞ্চকোট রাজবংশ জলশয়গুলি খনন করেছিল। এখন সংস্কারের অভাবে মজে যাচ্ছে।” তাঁর মতে, প্রশাসন শরিকদের সঙ্গে কথা বলে জলাশয়গুলি সংস্কারের কাজে হাত দিলে জলধারণ ক্ষমতা বাড়ত।
একই ছবি বাঘমুণ্ডির হরিডি গ্রামের হরিবাঁধেরও। এই গ্রামের বাসিন্দা নিধিরাম মাহাতো বলেন, “এই পুকুর আমাদের পূর্বপুরুষেরাই খনন করিয়েছিলেন। ৬৫ বিঘের পুকুর এখন মজে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।” এলাকার একাধিক গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে এই পুকুর আজও সমান গুরুত্বের। তিনি জানান, তাঁদের পক্ষে এখন এতবড় পুকুর সংস্কার করা সম্ভব নয়। প্রশাসনের কাছে সংস্কারের জন্য আবেদন করেছেন। সাড়া মেলেনি। বাঘমুণ্ডিই রানিবাঁধের অবস্থাও একই। কয়েক বছর আগে প্রশাসন প্রায় ৪৫ বিঘের এই জলাশয় সংস্কারের উদ্যোগী হলেও টাকার অভাবে কাজ শেষ করতে পারেনি। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের ধানাড়া গ্রামের বড়বাঁধ প্রায় ২২ বিঘে আয়তনের। এখনও এর জল ব্যবহার করা হয়। অথচ সংস্কারের অভাবে প্রায় অর্ধেক মজে গিয়েছে। এখানেও সেই শরিকি সমস্যা। শরিকদের অভিযোগ, প্রশাসনের কাছে সংস্কার চেয়ে আবেদন করেও লাভ হয়নি। ঝালদা পুরশহরের বড় জলাশয় লিহিরবাঁধেরও একই অবস্থা। ঝালদার পুরপ্রধান প্রদীপ কর্মকার বলেন, “লিহিরবাঁধ প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় মজে গিয়েছে। শরিকি মালিকানা থাকায় পুরসভার কিছুই করার নেই।”
ব্যতিক্রম পুরুলিয়া শহরের সাহেববাঁধ। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার ২০১০ সালে এই বাঁধকে জাতীয় সরোবরের স্বীকৃতি দেয়। এই বাঁধ বর্তমানে পুরুলিয়া পুরসভার অধীন। পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “জাতীয় সরোবরের স্বীকৃতি পাওয়ায় এখন সংস্কারের কাজ চলছে। ৮০ একর আয়তনের এই বাঁধকে ফের আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। বাঁধ লাগোয়া ১০ বিঘে আয়তনের কিং এর্ডওয়াড মেমোরিয়াল ট্যাঙ্কর সংস্কারের কাজও চলছে।” কিছুটা ভাল অবস্থায় রয়েছে আদ্রা ও আনাড়ার সাহেববাঁধ দু’টি। আদ্রা ও আনাড়ায় রেলকর্মী আবাসন গড়ে ওঠায় জলের চাহিদা মেটাতে দু’টি জায়গাতেই এই বাঁধগুলি খনন করা হয়। রেলকর্মী সংগঠনগুলি এই জলাশয়গুলির যথাযথ সংস্কার হচ্ছে না বলে দাবি করলেও রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, মাঝে মধ্যেই জলাশয়গুলির সংস্কার করা হয়।
জেলার মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো স্বীকার করেছেন, “ কালে কালে সংস্কারের অভাবেই অনেক পুকুর বা বাঁধ আজ মজে যাচ্ছে। কারণ এতদিন এ ব্যাপারে কেউ নজর দেয়নি। তবে এখন কী ভাবে এই জলাশয়গুলি সংস্কার করা যায়, তা প্রশাসনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলব।” অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) সবুজবরণ সরকারের দাবি, “জলধরো জলভরো প্রকল্পে পুকুর সংস্কারের কাজ যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। এই প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত ১৫ হাজার ৫৮৩টি জলাশয় গড়ে উঠেছে। তবে বড় পুকুর বা বাঁধ যা শরিকি আওতায় রয়েছে, সেগুলি সে ভাবে সংস্কারের কাজ করা হয়নি। তবে শরিকরা আবেদন করলে সরকার সংস্কারের কাজে হাত দিতে পারে।” |