অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশের পরিস্থিতি আশু পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না। রবিবার জামাতে ইসলাম ও অন্য মৌলবাদী সংগঠনগুলির সহিত যৌথ ভাবে বিরোধী দল বিএনপি দেশময় যে প্রতিবাদী ধর্মঘটের ডাক দিয়াছিল, তাহা ব্যর্থ হইয়াছে। হরতাল ও অচলাবস্থা সৃষ্টির হুমকি অগ্রাহ্য করিয়া লক্ষ-লক্ষ মানুষ পথে বাহির হইয়াছেন। রাজাকার ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে দেশময় মিছিল-শোভাযাত্রাও হইয়াছে। জামাতপন্থীরা ভাবিয়াছিলেন, পাল্টা চাপ দিয়া তাঁহারা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে কোণঠাসা করিয়া দিবেন। বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি জামাতের সহিত হাত মেলানোয় মৌলবাদীরা বাড়তি অক্সিজেনও পাইয়া যায়। এত কাল ’৭১-এর ঘাতকদের বিচারের জন্য গড়া ট্রাইবুনালের প্রকাশ্য বিরোধিতা না করিলেও বেগম জিয়ার দল নির্বাচনী দোসর জামাতে ইসলামের নেতাদের বিচার ও প্রাণদণ্ডের দাবি পরিপাক করিতে পারে নাই। ফলে গণঘাতক-গণধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল জনমতের বিপরীতে গিয়াও বিএনপি জামাতিদেরই মিত্র রূপে আলিঙ্গন করিয়াছে।
ইহার ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে মেরুকরণ স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগ গণদাবি শিরোধার্য করিয়া ট্রাইবুনালের তরফে কঠোরতর শাস্তির বিধানের বন্দোবস্ত করিয়া আপন জনসমর্থন বিপুল ভাবে বৃদ্ধি করিয়া লইতে সক্ষম হইয়াছে। অন্য দিকে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকদের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি লইয়াও বেগম জিয়ার বিএনপি মৌলবাদীদের সহিত হাত মিলাইয়াছে। ইহা দুর্ভাগ্যজনক, কেননা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানই ছিলেন সেই সমরনায়ক, যিনি সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের বেতারকেন্দ্র হইতে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন। আজ সেই মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও যে বিএনপি জামাতে ইসলামির সহিত জোট বাঁধাই মনস্থ করিল, যাহারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অধীন রাখিতে চাহিয়াছিল, মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতায় নামিয়া যোদ্ধাদের ধরাইয়া দিয়াছিল, নিজেরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক পরিবারগুলির নিরস্ত্র মানুষদের গণহত্যা ও গণধর্ষণে লিপ্ত হইয়াছিল। চল্লিশ বছর কাটিয়া গেলেও বাংলাদেশের জনমানসে মুক্তিযুদ্ধের স্থান অতি বৃহৎ, অতি সম্মানের: সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটি দ্রুত ‘জাতীয়’ প্রশ্নে পরিণত হইয়াছে। এমন একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে বিএনপি-র মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকারের সহিত হাত মিলাইতে পারিলেই ভাল হইত কিন্তু তাহা যদি না-ও সম্ভব হয়, তবু জামাত হইতে বিরোধী দল কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখিলেও বাংলাদেশের রাজনীতির মঙ্গল হইত।
পরিবর্তে জামাতি এবং বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, নেপথ্য হইতে আওয়ামি লিগের সরকার গণবিক্ষোভ উস্কাইয়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করিতে সচেষ্ট। হাসিনা ওয়াজেদের আওয়ামি লিগ সরকার ইসলাম ও পয়গম্বরের অসম্মান করিতেছে, এমন ধুয়াও তোলা হইতেছে। কিন্তু জামাতে ইসলামি আর ইসলাম তো এক নয়। তা ছাড়া শুদ্ধ ইসলাম কায়েম করার নামে তালিবান ও অন্য মৌলবাদীরা বিশ্বের অন্যত্র, সর্বত্র কী অমানবিক অনাচার নিয়মিত ঘটাইয়াছে, ইতিহাস তাহার সাক্ষী। কোনও আধুনিক, দায়বদ্ধ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনা বিচার ও শাস্তিতে এই সব অনাচার সহ্য করিয়া চলিতে পারে না, ইসলাম বা পয়গম্বরের নামে তাহা সংঘটিত হইলেও না। বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়। সেখানে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের হামলার ভয়ে নাগরিক সমাজ ঘরে খিল দিয়া বসিয়া থাকে নাই, পথে বাহির হইয়া তাহাদের চ্যালেঞ্জ করিয়াছে। জেহাদি মৌলবাদে সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্র যখন আপস ও আত্মসমর্পণের রাস্তায় হাঁটিতেছে, বাংলাদেশের সরকার তখন মৌলবাদ-বিরোধী তুমুল গণবিক্ষোভকে দিগভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে জামাতি ও তাহার সহযোগী বিশৃঙ্খলার শক্তিগুলিকে কড়া প্রশাসনিক দাওয়াইয়ে দমন করিতেছে। এই ব্যতিক্রমী ভূমিকার জন্য সমগ্র এশিয়া এক দিন ভারতের এই ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকিবে। |