বাসের পারমিটের চাহিদা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রত্যয়ী ছিলেন পরিবহণমন্ত্রী। কার্যক্ষেত্রে সেই প্রত্যয় বড় ধাক্কা খেল।
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বেসরকারি বাস-মালিকদের বার্তা দিয়েছিলেন, ভাড়া আর না-বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পছন্দ না-হলে তাঁরা যেন নিজের নিজের পারমিট জমা দিয়ে যান। মদনবাবু এ-ও ঘোষণা করেছিলেন, নতুন পারমিট নেওয়ার জন্য লাইন দিয়ে লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। পারমিট পেলে তাঁরাই বাস চালাবেন। মন্ত্রীর কথা শুনে এবং পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে পারমিট ছেড়ে দিতে শুরু করেছেন কিছু কিছু মালিক। অনেকে পারমিট নবীকরণ করেননি, ফলে বেশ ক’টা রুট ইতিমধ্যে বন্ধও হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু নতুন পারমিট নেওয়ার জন্য ‘লাইন পড়া’ দূরে থাক, কার্যত লোকই মিলছে না! অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, আবেদন করার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পারমিট দেওয়ার কথা ঘোষণা করতে হয়েছে পরিবহণমন্ত্রীকে। গত শুক্রবারের ওই ঘোষণাতেও বিশেষ লাভ হবে কি না, সে বিষয়ে পরিবহণ দফতরের কর্তাদের একাংশ ধন্দে রয়েছেন। যাঁরা ইতিমধ্যে আবেদন করে পারমিট পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেও দোটানায়। পুরনো ভাড়ায় বাস চালিয়ে লাভের মুখ দেখা সম্ভব কি না, তা ভেবে তাঁরা ঘোর সংশয়ে পড়ে গিয়েছেন। মন্ত্রী কী বলেন?
রবিবার মদনবাবু বলেন, “ঊনিশ বছর ধরে পারমিটের ফাইল চেপে রাখা হয়েছিল। আমরা এ বার দেওয়া শুরু করলাম। প্রতি মাসে একশো-দু’শো পারমিট দেওয়া হবে।”
|
ব্রাত্য বাহন |
|
বেসরকারি |
মিনি |
• নথিভুক্ত রুট |
৮৫ |
৮১ |
• বাস থাকার কথা |
৪৪৯৬ |
২১৩৯ |
• পারমিট নবীকরণ হয়নি* |
৯৪০ |
৪৩৬ |
• নতুন পারমিট |
২৮৬ |
৬৯ |
* বাসপিছু একটি পারমিট। |
তথ্য: পরিবহণ দফতর |
|
পারমিট প্রার্থীদের সংখ্যায় ভাটা পড়েনি বলেও পরিবহণমন্ত্রীর দাবি। যদিও বাস-মালিকদের একাংশ তা মানছেন না। তাঁদের প্রশ্ন, “আগে বাস-মিনিবাসের পারমিট পাওয়ার জন্য মোটর ভেহিক্লসের অফিসে দরখাস্তের পাহাড় জমত। রাইটার্সে নেতা-অফিসারদের ঘরের সামনে উমেদারের ভিড় লেগে থাকত। এখন সে সব কোথায়?” এই মহলের মতে, সরকার এখন সেধে পারমিট দিতে চাইলেও ছবিটা এ ভাবে পাল্টে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কেন?
মালিকদের একাংশের যুক্তি: আগে জ্বালানি বা যন্ত্রাংশের দাম বাড়লে সরকার বাস-মালিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় বসে ভাড়া বাড়াত। অথচ বর্তমান সরকার সে পথে হাঁটার বদলে জেদ ধরে রয়েছে, বাস্তব পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, ভাড়া বাড়বে না। পরিণামে বাস চালিয়ে লাভের মুখ দেখা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে ওঁদের অভিযোগ। তাঁদের দাবি, এই সমস্যার কারণে অনেকে পারমিট নবীকরণ করছেন না। আর যাঁরা নতুন পারমিট নিচ্ছেন, তাঁরাও বুঝতে পারছেন, এ ভাবে ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়।
তাই বাস-মালিকদের সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটসের নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “মনে হচ্ছে, বাস কাঁধে করে কাঁদার লোকের সংখ্যা আরও বাড়ল। যাঁরা নতুন পারমিট নিচ্ছেন, কিছু দিনের মধ্যে দুর্ভোগটা টের পাবেন। তখন ওঁরাও আমাদের সঙ্গে বসে কাঁদবেন।” মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা অবশেষ দাঁ-র মন্তব্য, “লাভ দূরের কথা। ব্যাঙ্কের কিস্তির টাকাও ওঁরা বোধহয় মেটাতে পারবেন না। বাস চালাতে শুরু করলেই বাস্তব অবস্থাটা ওঁদের মালুম হবে।”
বস্তুত পরিস্থিতির আঁচ টের পেতে শুরু করেছেন ‘ওঁদের’ অনেকে। ১২সি রুটে নতুন পারমিট পাওয়া এক বাস-মালিক বলছেন, “অগস্টে যখন পারমিটের আবেদন করেছিলাম, তখন অবস্থা অন্য রকম ছিল। এখন প্রতি মাসে ডিজেলের দাম বাড়ছে। কিন্তু ভাড়া বাড়ছে না। বাস নামালে ক্ষতি বই লাভ হবে না। পারমিট নিয়ে দেখছি ঝামেলায় পড়লাম!” ৩০বি রুটে নতুন পারমিট পাওয়া আর মালিকও মেনে নিচ্ছেন, এই মুহূর্তে বাস চালালে লোকসান অবশ্যম্ভাবী। তবে তিনি এখনও আশাবাদী। “সব সময় লাভ-লোকসান হিসেব করে চলা যায় না। এখন হয়তো ক্ষতি হবে। পরে কখনও লাভ হবে।” বলছেন তিনি।
জ্বালানির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস-ভাড়া বাড়ানোর কোনও ভাবনা আছে? রাজ্য পরিবহণ দফতরের এক কর্তার জবাব, “গত নভেম্বরে বাস-ভাড়া বাড়িয়ে তা ফের কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। কাজেই এখন আর ভাড়াবৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাতে পরিবহণের হাল যা-ই হোক না কেন!”
অতএব মন্ত্রী যতই পারমিট নিয়ে তৈরি থাকুন, নেওয়ার লোক কত মিলবে সে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
|