অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতদুটো ভূখণ্ডেই আজ ব্যক্তিগত জয়ের দিন ছিল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির! অস্ট্রেলিয়ার জয়টা কেবল এল ঘণ্টাখানেক আগে।
এটুকু পড়ে যদি মনে হয় রূপকার্থে লেখা হল। প্রথমে ধোনি মাঠের যুদ্ধে জিতলেন ব্যাগি গ্রিনের বিরুদ্ধে। তার পর ভারতীয় সমালোচকদের বিরুদ্ধে। না, আক্ষরিক অর্থে লেখা হল। ব্যাট হাতে অস্ট্রেলীয়দের কুচি-কুচি করে কাটার ঘণ্টাখানেক আগেই ধোনি সুখবরটা পেয়ে গিয়েছিলেন যে, রোববার সকালে মেলবোর্ন শহরতলিতে তাঁর টিম সুপারবাইক ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে জয় দিয়ে শুরু করেছে।
চ্যাম্পিয়নশিপটা ছিল ফিলিপ আইল্যান্ডে। আসলে সুপারবাইকের ২০১৩ মরসুম এই শুরু হল। জয়ী ঠিক হতে হতে মাঝ নভেম্বর। ধোনির দলের নামমাহি রেসিং টিম ইন্ডিয়া। বিশ্ব সুপারবাইকে গত বছর থেকে প্রথম নাম দিচ্ছে ভারত। আর টিম মালিক হলেন ধোনি। তুরস্কের বিশ্বখ্যাত এক বাইক চালককে এ বার তিনি দলে নিয়েছেন। সে-ই ভারত অধিনায়ককে আজ সচিন-কোহলি ব্যাট করতে নামার কাছাকাছি সময়ে বাইকে দৌড়ে জিতিয়ে দিল।
টিমের বাহন কাওয়াসাকি নিনজা জেড এক্স-সিক্স আর। সিক্স হান্ড্রেড সিসি সুপার মোটরবাইক। আর চিপকের পিচেও যেন সিক্স হান্ড্রেড সিসি মোটরবাইকের গতি নিয়ে এসেছিলেন ধোনি।
ফয়জলাবাদে সাত বছর আগে ওঁর অনবদ্য একটা টেস্ট সেঞ্চুরি দেখেছি। মাহি-র অ্যাদ্দিন ওটাই টেস্টে সর্বোচ্চ রান ছিল১৪৮। ইনিংসের বৈশিষ্ট্য ছিল কনুই ভেঙে ক্রমাগত ছুড়তে থাকা শোয়েব আখতারকে অসমসাহসে মোকাবিলা করা। শোয়েব এমনিতেই তখন ঘণ্টায় ১৫৫ কিমি গতিতে বল করতেন। অবারিত চাকিংয়ে তা সময় সময় ১৬০-১৬৫ কিমিতে পৌঁছে যাচ্ছিল। মনুষ্যের পক্ষে সেই বোলিং সামলানো অসাধ্য। তেন্ডুলকর অবধি বারবার আম্পায়ারের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এটা কী হচ্ছে! ওকে ডাকুন! ধোনি তাকানওনি। রানটা করে যান। মুগ্ধ অধিনায়ক দ্রাবিড় দিনশেষে বলেছিলেন, তাঁর দেখা “সেরা প্রতিআক্রমণের সেঞ্চুরি।”
আইপিএলের জন্য অনুশীলনের ফাঁকে ধোনির ইনিংস দেখার সুযোগ পেলে দ্রাবিড় হয়তো এ দিন ভূলুন্ঠিত নানান রেকর্ডের মতোই নতুন আপডেট দিতেনচিপকই সেরা।
|
চিপকই সেরা বলতে গিয়ে মনে পড়ল এই মাঠেই তেন্ডুলকরের একাধিক অনবদ্য টেস্ট জেতানো সেঞ্চুরি আছে। আছে তারও ওপরে ভয়ঙ্কর অ্যান্ডি রবার্টস সামলে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের ৯৭। ধোনির আজকের ২৩১ বলে ২০০ সেই কুলীন ইনিংসগুলোর সরণিতেই পড়বে। দাক্ষিণাত্যের ক্রিকেটার মনে করিয়ে দিলেন ইডেনে গ্রাহাম গুচের টিমের বিরুদ্ধে তখনকার অধিনায়ক আজহারউদ্দিনের ১৮২। প্রাণান্তকর চাপের মধ্যে সেই ১৯৯৩-র আজহার। তাঁকে সরিয়ে কপিলকে ক্যাপ্টেন করে দেওয়া হয় আর কী। এই সময় ইংরেজ বোলারদের ঠেঙিয়ে তাঁর ইনিংস। ধোনির সঙ্গে আর একটা আশ্চর্য মিল। যখন যাঁর সঙ্গে পার্টনারশিপ হোক, শতকরা ৬৫ শতাংশ রান সংগ্রহ একা অধিনায়কের।
তবু সংখ্যায় যতই মিল থাক, ইনিংস মাহাত্ম্যে নেই। আজহারেরটা তুলির ছিল। মনে থেকে যায় হয়তো বেশি। ধোনিরটা পাশবিক। বিপক্ষকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো। কোনও ভারতীয়ের শটে এই গতি কখনও ছিল কি না স্পিড-গান যদি অনুসন্ধান করতে পারত। দ্বিতীয় নতুন বল অস্ট্রেলিয়া নিয়ে ফেলার পর ধোনি যেন সুপারবাইক নিয়ে চড়াও হলেন তাদের ওপর। ৯৩ রানে এলবিডব্লিউয়ের জোরালো আবেদন থেকে বেঁচেছেন ঠিকই। সে তো ক্লার্কও প্রথম দিন ৩৯ রানে বেঁচে ১৩০ করে গিয়েছেন।
এমন ঠেঙিয়েছেন ধোনি যে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ যদি বা বাঁচাতে পারে। তাদের ভারতীয় মডেল মেরিনা বিচের ধারে পড়ে কাতরাচ্ছে। ক্লার্করা যে ডিজাইনার রক্ষণাত্মক ফিল্ড প্লেসিং করছিলেন। এমনকী নতুন বলেও স্লিপ না রেখে রান চোক করার কৌশল কাজে লাগাচ্ছিলেন। সেটা সম্পূর্ণ অকেজো। এক স্পিনার নিয়ে খেলা অকেজো। সবচেয়ে বড় কথা ২২ বাউন্ডারি, ৫টা বিশাল ছক্কায় অজিদের বাকি সিরিজের মনোবলটাই তো ‘শাট ডাউন’ হয়ে গেল।
এমনিতে চেন্নাইয়ে ধোনির যা জনপ্রিয়তা দেখছি রজনীকান্ত-কমল হাসনদের সঙ্গে তুলনীয়। স্কোরবোর্ডে বারবার ভেসে উঠছিল নাম্মা ধোনি। অর্থাৎ, আমাদের ধোনি। গ্যালারিতে সাত নম্বর জার্সি পরা অন্তত শ’খানেক সমর্থক। সকালটা যদিও তেন্ডুলকরের ছিল। এমন উত্তাল ভিড় ভোর থেকে যা সত্তর দশকের মোহন-ইস্ট টিকিট হাহাকারকে মনে করিয়ে দেয়। গোটা ভারতের চাহিদা ছিল ২৯ রানের। লিয়ঁ-র একটা বল বাঁ হাতি স্টার্কের তৈরি করা ফুটমার্কে পড়ে আচমকা ঘুরে যাওয়ায় ২৯ রানের স্বপ্নটা আটকে গেল ১৯ বাকি থাকতে। কে জানত গোটা ম্যাচে অস্ট্রেলীয় বোলার ওই একটাই অফস্পিনারের স্বপ্নের ডেলিভারি করবে। আর সেটাই হৃদয় ভেঙে দেবে রবিবাসরীয় জমায়েতের।
ধোনি যেন এদের ব্যথা ‘ফিল’ করছিলেন। আর তাই সচিনের সম্ভাব্য সেঞ্চুরির দ্বিগুণ বিনোদন দিয়ে গেলেন। বিরাট কোহলির এত ভাল সেঞ্চুরিও তাঁর অজি-সংহারের পাশে কখনও কখনও চিফ অ্যাসিস্ট্যান্টের ভূমিকায় চলে যাচ্ছিল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগছিল মাইলস্টোনগুলো টপকে যাওয়ার পর ধোনির প্রকাশভঙ্গি। বিশ্বকাপ ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন করা ছক্কার পর নির্বিকার ভাবে ব্যাটটা ঘুরিয়েছিলেন। এখানে প্যাটিনসনকে চেত্তা খেয়ে মারা বাউন্ডারিতে সেঞ্চুরির পর এত পরে ব্যাট তুললেন যেন কিছুই হয়নি। আর ডাবল সেঞ্চুরি পূর্ণ করার পরেও যথেষ্ট নির্বিকার। এ বারও হেলমেট খুললেন না। ডাবল সেঞ্চুরি ৮৭ স্ট্রাইক রেট নিয়ে এক-আধ জন হয়তো করেছেন। কিন্তু দুশোর পর হেলমেট খোলেননি এমন অবশ্যই কেউ নেই।
পছন্দ করুন বা বর্জন। যা ইচ্ছে নাম দিন। ঔদ্ধত্য। মস্তানি। শীতল অহঙ্কার। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মধ্যে কিন্তু একটা ব্যাপার আছে।
|
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস ৩৮০ |
ভারত প্রথম ইনিংস (আগের দিন ১৮২-৩) |
সচিন বো লিয়ঁ ৮১
কোহলি ক স্টার্ক বো লিয়ঁ ১০৭
ধোনি ন.আ. ২০৬
জাডেজা বো প্যাটিনসন ১৬
অশ্বিন বো লিয়ঁ ৩
হরভজন বো এনরিকে ১১
ভুবনেশ্বর ন.আ. ১৬
অতিরিক্ত ১৯
মোট ৫১৫-৮।
পতন: ১১, ১২, ১০৫, ১৯৬, ৩২৪, ৩৬৫, ৩৭২, ৪০৬।
বোলিং: স্টার্ক ২৫-৩-৭৫-০, প্যাটিনসন ২৬-৫-৮৯-৪, সিডল ২২-৫-৬১-০,
লিয়ঁ ৪০-১-১৮২-৩, এনরিকে ১৭-৪-৪৮-১, ক্লার্ক ৮-২-২৫-০, ওয়ার্নার ৩-০-১৯-০। |
|
|