ভারতীয় টিম হোটেল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে চেন্নাইয়ের আরও একটা পাঁচতারা হোটেল। টিভি ভাষ্যকারদের যা আস্তানা। সেখান থেকে রোববার রাতে হিমশীতল গলায় রবি শাস্ত্রী জানতে চাইছেন, “এত ক্ষণ অপেক্ষা করলাম রেডিও-টিভি শোনার জন্য। কই, কাউকে তো খুঁজে পাচ্ছি না। সমালোচকগুলো কি তা হলে মাহি-র ব্যাটের হ্যান্ডলের মধ্যে ঢুকে বসে রয়েছে?”
শাস্ত্রীর গলায় ঝরে ঝরে পড়ছে তীব্রতম ব্যঙ্গ আর ক্ষোভ। গত এক বছর ধোনিকে ধারাবাহিক সমর্থন করার জন্য তাঁকেও ধারাবাহিক সমালোচনা শুনতে হয়েছে। গরিষ্ঠ মত থেকেছে এই যে, বোর্ড প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাসীন লবির ঘনিষ্ঠ থাকার ফন্দি নিয়ে তিনি মিডিয়ায় ধোনির প্রতি ‘ইচ্ছাকৃত পক্ষপাতিত্ব’ করে চলেছেন। আজ মনে হল শাস্ত্রীর পাল্টা বলার দিন। বললেন, “আমি নির্লজ্জ নই বিশ্লেষণে। দু’টো ক্রিকেটারকে সাপোর্ট করেছি। এক সময় সচিন। ইদানীং ধোনি।”
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি! তিনি নিজে কী বলছেন একই সঙ্গে রোমাঞ্চ, শিহরন আর অতিবিস্ময় সৃষ্টি করে দেওয়া এমন ঐতিহাসিক ইনিংস খেলে উঠে? ৮৭ স্ট্রাইক রেট নিয়ে ডাবল সেঞ্চুরি আজ পর্যন্ত কোনও ভারত অধিনায়ক করেনি। ভারতের কোনও উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের ডাবল সেঞ্চুরিও নেই। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এত স্কোরও কোনও ভারত অধিনায়ক করেননি। |
অথচ এ সবই স্ট্যাটিস্টিশিয়ানদের জগতে তোলপাড় ফেলে দেওয়া নতুন নতুন মিনার। রোববারের মহাতাণ্ডব সমন্বিত ক্যাপ্টেন’স ইনিংসের একটাই সারমর্ম: ভাইরা, আর আমায় অধিনায়কত্ব নিয়ে জ্বালাতে এসো না!
ভারতীয় ক্রিকেটের জন্ম একাশি বছর আগে। আজ পর্যন্ত তার কোনও অধিনায়কের এত প্রতিকূল চাপের বিরুদ্ধে সাঁতরে পাড়ে ওঠার কাহিনি নেই। অস্ট্রেলিয়ার চার-পাঁচটা বোলার তো স্রেফ তাঁকে মাঠে বল করলেন। ধোনি আসল আক্রমণ খেলছেন মাঠের বাইরে। আর সেটা নিজ দেশীয় বোলারদের বিরুদ্ধে। এরা কেউ টিমমেট হতে পারে। কেউ প্রাক্তন নির্বাচক হতে পারে। কেউ প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক হতে পারে। কেউ সাংবাদিক হতে পারে। কেউ বোর্ড সদস্য হতে পারে। এক-এক জন এক-এক রকম কারণে বিরোধী। তবে মূল সুর একটাই: লোকটা স্বেচ্ছাচারী। যথেষ্ট পারফরম্যান্স নেই। স্রেফ বোর্ডের মদতে টিকে রয়েছে। সৌজন্য বা ভদ্রতার তোয়াক্কা করে না। পরের পর সিরিজ হেরেও থেকে যায় স্রেফ কপালগুণে।
ধোনির বন্ধু-সমর্থক-সমালোচক-অপছন্দকারীদের তালিকা হতে পারে এ রকম:
বন্ধু: সুরেশ রায়না। আরপি সিংহ। প্রবীণ কুমার। আর মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হবে।
সমর্থক: এন শ্রীনিবাসন। রবি শাস্ত্রী। গ্রেগ চ্যাপেল। দিলীপ বেঙ্গসরকর।
সমালোচক: সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। রাহুল দ্রাবিড়। মোহিন্দর অমরনাথ। সুনীল গাওস্কর। স্টিভ ওয়। আজহারউদ্দিন। কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত। রাজা বেঙ্কট। অশোক মলহোত্র এবং আরও অনেকে।
অপছন্দকারী: ভিভিএস লক্ষ্মণ, যুবরাজ সিংহ, বীরেন্দ্র সহবাগ, গৌতম গম্ভীর, হরভজন সিংহ। জাহির খান। মনোজ তিওয়ারি এবং আরও অনেকে। |
মিডিয়ার নন-টেকনিক্যাল অংশ: মোটামুটি সবারই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। যে হেতু গত দেড় বছরেরও বেশি তাঁর অধীনে ভারত সিরিজ হেরেই চলেছে।
শত্রু-বন্ধুদের তালিকাই বলে দিচ্ছে শ্রীনিবাসন নিজ কর্তৃত্বে যতই ভারত অধিনায়ককে ক্ষমতায় রেখে দিন, ভারতের সার্বভৌম ক্রিকেট-ভূখণ্ড তাঁকে মানসিক ভাবে শরশয্যায় শুইয়ে রেখেছিল। পরিষ্কার বলা হত, জেটলি আসুন না বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়ে। দেখি কেমন থাকে!
ভারতীয় ক্রিকেট-অলিন্দ সব সময় চাপা বিদ্রোহের জন্য তৈরি থাকে। প্রবল ক্ষমতাবানও সেখানে এক রাত্তিরের প্রভাবশালী অভ্যুত্থানে গদি হারাতে পারেন। সুতরাং অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরি ধোনিকে আরও দু’বছর লাইসেন্স দিয়ে দিল বলে যাঁরা মনস্তাপ করছিলেন, তাঁদের এতটা দুঃখবোধেরও আবার কারণ নেই।
একই সঙ্গে এটা খুব সত্যি, চিপকের বিক্রমে নিজের টেস্ট ব্যাটসম্যানশিপের পাশে, সর্বোপরি নিজের যোগ্যতার পাশে অবশেষে বিশ্বাসযোগ্যতার সুইচ অন করতে পারলেন ধোনি। ফিউজের যে তারটা বেশ কিছু দিন কাটা ছিল। শাস্ত্রী মনে করেন, আজকের পারফরম্যান্সের পর অধিনায়কত্ব এবং ব্যাটিং বিক্রম দুইয়ে মিলে ভারতের সর্বকালের সেরাদের মধ্যে চলে এলেন ধোনি। একমত হন বা না হন, শাস্ত্রীর সেই ছোট তালিকা এ রকম: সচিন। গাওস্কর। কপিল। দ্রাবিড়। কুম্বলে। হাজারে। ধোনি। শরশয্যা থেকে মহা-অভিজাত উত্থানের দিনে একটা প্রশ্ন উঠেই পড়ে। অ্যাদ্দিন ভারত অধিনায়ককে জিজ্ঞেস করা হত, মাঠে এত ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল থাকেন কী করে? রোববারে নতুন প্রশ্ন এসে গিয়েছে আগেরটা কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে মুছে গিয়ে মাঠে আর মাঠের বাইরে এত আক্রমণ সামলে কী করে আপনার ব্যাটে এত জোর থাকে? ধোনি-ঘনিষ্ঠ নয়াদিল্লিবাসী অরুণ পাণ্ডে মেলবোর্ন থেকে ফোনে বলছিলেন, তার কারণ মাহি-র জীবনদর্শন। অরুণ ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার। ধোনির ব্যবসায়িক সব কাজ দেখেন। বলেন, “ওর চিন্তাধারাটা খুব সাফ। মেহনত করো আর পেশাদার ভাবনায় সৎ থাকো। যদি দু’টোই নিষ্ঠা ভরে করে যেতে পারো, দেখবে প্রকৃতি তোমার অলক্ষ্যে তোমার জন্য একটা এনার্জি তৈরি করে দিয়েছে। সেই এনার্জি যখন তোমার সওয়ার হবে, দেখবে তোমায় কিছু করতে হবে না। সে-ই দেখবে অবিশ্বাস্য ভাবে আশপাশের সব বাধা মেরে কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছে।” আর যদি এনার্জি তৈরি না হয়? তারও উত্তর রয়েছে ধোনির কাছে। “বুঝতে হবে তখন তোমার সততায় কিছু ঘাটতি থেকে গিয়েছিল।”
দু’টো বিশ্বকাপ। ভারতকে নিজের নেতৃত্বে টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হতে দেখার কৃতিত্ব। আর অধিনায়ক হিসেবে এ দিনের ডাবল সেঞ্চুরি-সহ ৪৫ টেস্ট গড়। শাস্ত্রী বলছিলেন, “এগুলো দয়া করে যোগ করবেন। এর সঙ্গে উইকেটকিপিং আর ওয়ান ডে-তে দীর্ঘ দিন বিশ্বের পয়লা নম্বর থাকা। যোগ শেষ হলে আমায় ফোন করে বলবেন কত হল। ওই লোকগুলো হ্যান্ডলের ভেতর থেকে বেরিয়েছে কি না, সেটাও জানাতে ভুলবেন না যেন।” ধোনি-বিরোধী অংশ রোববার রাতে সত্যিই নিশ্চুপ। তার চেয়েও বেশি বিহ্বল। ধোনি এমন চাপের মুখে এই ইনিংস খেলে দেবেন, কেউ ভাবেননি। সচরাচর এ সব ক্ষেত্রে বলা হয়, সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার মানে হয় না। জো জিতা ওহি সিকন্দর। এখানে বাড়তির মধ্যে বলা হচ্ছে, রাজসভাটা তো আজ ছিল সচিনের জন্য। কী করে ধোনি বসে পড়ল সিংহাসনে?
|
পিচ না ফরাসি ওপেনের ক্লে কোর্ট! চিপকে তৃতীয় দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর সোশ্যাল সাইটে এই নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। বিতর্কের জনক শেন ওয়ার্ন। পিচের একটা ছবি তুলে নিজের টুইটারে পোস্ট করেন ওয়ার্ন। সঙ্গে টুইট: ক্লে কোর্টের সেরা প্লেয়ারকে অস্ট্রেলিয়া দলের বাইরে রেখেছে। রাফায়েল নাদাল। চেন্নাইয়ের পিচ যে ক্রমে খারাপ হবে, তা নিয়ে বিশেষ দ্বিধায় নেই ক্রিকেটমহল। অশ্বিনের কোচ সুনীল সুব্রহ্মণ্যম যেমন বলেছেন, “দীর্ঘ দিন এই মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এ রকম পিচ দেখিনি। প্রচণ্ড শুকনো। আগামী দু’দিন আরও ভাঙবে।” অস্ট্রেলিয়ার কিপার-ব্যাটসম্যান ম্যাথু ওয়েড বলে গিয়েছেন, “যত ম্যাচ গড়াবে উইকেট আরও খারাপ হবে। তবে এই পিচে কী ভাবে ব্যাট করতে হয় সেটা ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা দেখিয়ে দিল।” আসল কথাটা ওয়ার্নই বলে দিয়েছেন, “এই পিচে অস্ট্রেলিয়ার কাজটা খুব কঠিন হবে।”
|
ওয়ার্নের টুইট |
অস্ট্রেলিয়া টিমটা বাছতে ভুল করেছে...ক্লে-তে সেরা প্লেয়ার হল নাদাল ওকে অবশ্যই দলে রাখা উচিত ছিল!! হা হা হা... |
|