যে দেশে প্রতি বছর অন্তত এক কোটি তরুণ-তরুণী রুটি-রুজির সন্ধানে নামেন, সে দেশের অর্থমন্ত্রী কি আর্থিক বৃদ্ধির কথা ভুলে থাকতে পারেন? প্রশ্নটা নতুন নয়। কিন্তু বৃহস্পতিবারের বাজেটে পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম কী উত্তর দেন, সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে শিল্পমহল।
অর্থমন্ত্রীর কাছে তাদের প্রত্যাশার তালিকাটা দীর্ঘ। যার অন্যতম হল, লগ্নি টানতে পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর, রাজকোষে ঘাটতি কমানো, পণ্য পরিষেবা কর চালু করা, পরোক্ষ কর না-বাড়ানো এবং আয়করের কাঠামো এমন করা, যাতে মানুষের হাতে খরচ করার মতো টাকা থাকে। কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। ফলে জনগণের মন রাখার টানে শিল্পমহলের জন্য সরকারের ভাঁড়ারে কতটুকু পড়ে থাকবে, তা নিয়ে সংশয় কম নয়।
শিল্পমহল অবশ্য মনে করছে, লগ্নিকারীদের উদ্দেশে এ বারের বাজেটে ইতিবাচক বার্তা দেওয়াটা জরুরি। কারণ নতুন লগ্নি হলে তবেই নতুন শিল্প, কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য। তা হলেই নতুন কর্মসংস্থান, আয়ের সুযোগ। আর এত দিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, এ দেশের বেহাল আর্থিক অবস্থার জন্য যত না আমেরিকা-ইউরোপের মন্দা দায়ী, তার থেকে অনেক বেশি দায়ী ঘরোয়া সমস্যা। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ভারতে মন্দার প্রথম কারণ, পিছিয়ে পড়া পরিকাঠামো। দ্বিতীয় কারণ, এ দেশের শিল্পপতিরা ভারতে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছেন।
শিল্পমহল তাই চাইছে, মনমোহন সরকার সবার আগে জোর দিক পরিকাঠামোয়। তা সে সড়কই হোক, বা বিদ্যুৎ কিংবা টেলিযোগাযোগ। শিল্পমহলের অভিযোগ, ছাড়পত্রের বজ্র আঁটুনি, লগ্নির জন্য ঋণের অভাব ও সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে ঢিলেমির জন্য পরিকাঠামো ক্ষেত্র ধুঁকছে। পরের পর দুর্নীতির অভিযোগে জেরবার সরকারের অন্দরমহলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এর ফলে শুধু বিদ্যুৎ ক্ষেত্রেই হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প আটকে রয়েছে। হয় পরিবেশের ছাড়পত্র মিলছে না। নয়তো কয়লা জোগানের নিশ্চয়তা নেই। কিংবা জমি অধিগ্রহণের সমস্যা। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বড় প্রকল্পকে দ্রুত ছাড়পত্র দিতে চিদম্বরমের পরিকল্পনা অনুযায়ীই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বিশেষ কমিটি তৈরি হয়েছে। চিদম্বরমের কাছে এ বার শিল্পমহলের দাবি, পরিকাঠামোয় লগ্নির জন্য যাতে অর্থের অভাব না হয়, তার জন্য বিমা ও পেনশন তহবিলের অর্থ এই খাতে ব্যবহার করতে দেওয়া হোক। পরিকাঠামো ক্ষেত্রকে ন্যূনতম কর (ম্যাট) থেকেও ছাড় দেওয়া হোক। পরিকাঠামোকে অগ্রাধিকার ক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা হোক।
শিল্পমহলের বিরক্তি বাড়িয়েছে জিএসটি চালু করা নিয়ে টালবাহানাও। ২০০৬-’০৭-এ ঘোষণা হয়েছিল, পাঁচ বছরে চালু হবে এই কর। তার পরের চার বছরে কোনও কাজই হয়নি। শিল্পমহল চাইছে, দ্রুত জিএসটি চালুর ব্যবস্থা হোক। উৎপাদন শুল্ক, পরিষেবা কর, আমদানি শুল্কের হার অপরিবর্তিত থাকুক। গোটা বিশ্বেই মন্দার কারণে রফতানি কমে গিয়েছে। এই ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে কিছু উৎসাহবর্ধক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হোক।
শিল্পমহলের আর একটি দাবি, আয়কর ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হোক। দু’লক্ষ টাকার বদলে আড়াই লক্ষ টাকা আয় হলে তবেই কর বসুক। ১০ লক্ষ টাকার বদলে ২০ লক্ষ টাকার বেশি আয়ে ৩০% হারে কর চাপানো হোক। কারণ মানুষের হাতে খরচ করার মতো টাকা বাড়লে তা বৃদ্ধির গতি বাড়াতে সাহায্য করবে।
গত বাজেটে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কর ফাঁকি প্রতিরোধ আইন (জিএএআর) এবং ভোডাফোন-চুক্তিতে কর আদায়ের জন্য আইন সংশোধনকে ভাল চোখে দেখেনি শিল্পমহল। চিদম্বরম প্রথমটিকে হিমঘরে পাঠিয়েছেন। দ্বিতীয়টিরও পুনরাবৃত্তি চাইছে না শিল্পমহল।
শিল্পপতি, বণিকসভাগুলির সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর প্রাক-বাজেট বৈঠকে বলা হয়েছিল, সরকার যদি রাজকোষ ঘাটতিতে লাগাম পড়ানোর সদিচ্ছা দেখায়, সেটাই ইতিবাচক বার্তা দেবে। আদি গোদরেজ, আনন্দ মহীন্দ্র, রাজকুমার ধুতদের যুক্তি, সরকার বাজার থেকে কম ধার করলে সুদের হার কমবে। শিল্পের জন্য ঋণ পাওয়া সহজ হবে। এ দেশে বিনিয়োগ করতে ভরসা পাবেন লগ্নিকারীরা। চিদম্বরম ভরসা দিয়েছেন, তিনি চেষ্টা করবেন।
সরকারের আর একটি চিন্তা লেনদেনের ঘাটতি। বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। ফলে ডলার আমদানি কমেছে। আবার রফতানি কমার ফলেও ডলারে আয় কমেছে। দেশের রফতানিকারীদের সংগঠন ‘ফিও’-র সভাপতি রফিক আহমেদের দাবি, “ভারতীয় পণ্যগুলির বিদেশে প্রচারের জন্য সরকার একটি তহবিল তৈরি করুক। বিভিন্ন করের ক্ষেত্রেও কিছুটা ছাড় দেওয়া হোক।”
কিন্তু ঘুরে ফিরে সমস্যা একটাই। আগামী বছরের ভোটের কথা মাথায় রেখে শিল্পমহলের জন্য কতটা উদার হতে পারবে সরকার?
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ সমীরণ চক্রবর্তী যে কারণে বলছেন, এ বারের বাজেটে বৈপ্লবিক কিছু আশা না করাই ভাল। |