চার্জশিট জমা পড়েছিল ঘটনার সাতাশ মাস পরে। তারও পরে কেটেছে প্রায় চার বছর। এখনও শুরু হয়নি কাটোয়ার কংগ্রেস কর্মী তুহিন সামন্ত হত্যার বিচার। একের পর এক আইনি জটিলতায় মামলার চার্জ গঠনই হয়নি।
দেরিতে হলেও চার্জশিট জমা পড়ায় খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিল তুহিনবাবুর পরিবার। কিন্তু ঘটনার ছ’বছর পরেও বিচার শুরু না হওয়ায় তাঁরা রীতিমতো হতাশ। ছ’বছর আগের যে দিনটায় নিজের বড় ছেলেকে হারান, তার ঠিক আগের দিন, রবিবার কাটোয়ার নন্দীগ্রামে নিজের বাড়িতে বসে বৃদ্ধ শরদিন্দু সামন্তের গলায় ঝরে পড়ে ক্ষোভ, “কবে যে বিচার শুরু হবে, কবেই বা দোষীরা শাস্তি পাবে, বুঝতে পারছি না।” নাগাড়ে আইনি লড়াই করে কিছুটা ক্লান্তও হয়ে পড়েছে সামন্ত পরিবার। কিন্তু, লড়াই ছাড়তে নারাজ। |
২০০৭-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি কাটোয়ার চাণ্ডুলি হাইস্কুলে পরিচালন সমিতির ভোটে সিপিএম-কংগ্রেস গোলমাল বাধে। অশান্তি ছড়ায় স্কুলের বাইরেও। অভিযোগ, গোলমাল থামানোর নামে কাটোয়ার তৎকালীন ওসি দেবজ্যোতি সাহা গুলি ছোড়েন। নিহত হন মুর্শিদাবাদের কান্দির বিমলচন্দ্র আইন কলেজের আংশিক সময়ের শিক্ষক তুহিনবাবু। প্রতক্ষ্যদর্শী হিসেবে কাটোয়া থানার এক প্রাক্তন সাব-ইনস্পেক্টর দেবজ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে ‘অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর’ অভিযোগ দায়ের করেন। গ্রেফতার হলেও এক সপ্তাহের মধ্যে জামিন পেয়ে যান অভিযুক্ত ওসি।
|
তুহিন |
তুহিনবাবুর পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ প্রথমে ঘটনাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায়নি।
তাই নিহতের ভাই তুষার সামন্ত কাটোয়া আদালতে দেবজ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। স্থানীয় সাত সিপিএম নেতার বিরুদ্ধে খুনের চক্রান্তের অভিযোগ করা হয়। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে রাজ্য সরকার তদন্তভার তুলে দেয় সিআইডি-র হাতে। ২০০৭-এর ৯ মার্চ গড়িয়া থেকে দেবজ্যোতিবাবুকে ফের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ৯০ দিনের মধ্যে সিআইডি চার্জশিট জমা দিতে না পারায় দেবজ্যোতিবাবু ও ধৃত সাত সিপিএম নেতা জামিন পেয়ে যান। শেষে ২০০৯ সালের ১৯ মে সিআইডি কাটোয়া আদালতে মামলার চার্জশিট পেশ করে। তাতে জানানো হয়, ৮৭ জন সাক্ষীর বয়ান নেওয়া হয়েছে। যে নাইন এমএম পিস্তল থেকে গুলি চালানো হয়েছিল, দেবজ্যোতিবাবুর কাছ থেকে সেটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সিআইডি গুলিটি পরীক্ষার জন্য ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে পাঠায়। সেখানকার বিশেষজ্ঞেরা জানান, ওই গুলিতেই ফুটো হয়েছিল তুহিনের জামা।
চার্জশিট দেওয়ার প্রায় চার বছর পরেও চার্জ গঠন হল না কেন? পুলিশ জানায়, চার্জশিট জমা পড়ার পরে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আদালতে হাজির হননি সব অভিযুক্ত। এ ভাবে এক বছর কাটার পরে ২০১০-এর ২৩ এপ্রিল নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে মামলাটি বর্ধমান জেলা আদালতে স্থানান্তরের আবেদন করেন ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত সিপিএম নেতা হরিনারায়ণ সামন্ত। কয়েক মাস শুনানি চলার পরে জেলা আদালত সেই আবেদন খারিজ করে। দেবজ্যোতিবাবু কাটোয়ায় আইনজীবী পেতে অসুবিধার কারণ দেখিয়ে বর্ধমান আদালতে মামলা স্থানান্তরের আবেদন করেন। তার শুনানি চলে প্রায় ৩ বছর ধরে। ১৭ জানুয়ারি আবেদন খারিজ হয়। ফলে, চার্জ গঠন আর হয়ে ওঠেনি।
ঘটনার সময়ে তুহিনবাবুর ছেলে ত্রিদিবের বয়স ছিল তিন বছর। তার মা নিষাদদেবী জানান, ছেলে এখনও বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। শরদিন্দুবাবু বলেন, “দোষীরা শাস্তি না পেলে নাতিকে কী জবাব দেব জানি না।” সিআইডি সূত্রে জানা যায়, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি কাটোয়া আদালতে সব অভিযুক্তের হাজিরা রয়েছে। সে দিন চার্জ গঠনের দিন ঠিক হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। মূল অভিযুক্ত দেবজ্যোতিবাবু সল্টলেকে ‘ক্রাইম ব্যুরো’য় কর্মরত। কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “গার্ডেনরিচে নিহত এসআইয়ের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। অথচ তুহিনের পরিবার আজও বিচার পেল না।” |