তারা বাজি
এই পথ যদি না শেষ হয়

১৯ জানুয়ারি, ২০১৩। রাত ১১-২০। নায়ক হিরণ শো করে গাড়িতে ফিরছিলেন মেদিনীপুর থেকে। উল্টো দিক থেকে একটা লরি আসছিল। লরির সঙ্গে সংঘাত বাঁচাতে হিরণের গাড়ি আচমকা উঠে পড়ল রাস্তার ধারে জমা করে রাখা পাঁচ কী ছ’ফুট উঁচু পাথরকুচির স্তূপের ওপর। তিন-চার বার ওলটপালট খেয়ে গাড়ি গিয়ে পড়ল রাস্তার পাশে এক খাদে। তার পর তিন সপ্তাহ তিনি শুতে পারেননি। সারাক্ষণ তাঁকে বসে থাকতে হত শরীরের বাঁ দিকের বিভিন্ন অংশের যন্ত্রণা নিয়ে।
২৮ অক্টোবর, ২০১২। রাত ১২টা। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর থেকে গাড়িটা ঝড়ের বেগে ছুটছিল কলকাতার দিকে। যাত্রা সেরে ফিরছিলেন অভিনেতা অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। অন্ডালের মোড়ে এসে হঠাৎ একটা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের গায়ে সজোরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কোয়ালিস গাড়িটা। গুরুতর আহত অরিন্দমের ভাঙা নাকের সার্জারি করতে হল। বুকের পাঁজরে দারুণ চোট। দু’মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। বললেন, “এর পর শো করতে যাব না, তা নয়। কিন্তু অনেক সতর্কতা নিতে হবে। বিশেষ করে ড্রাইভারদের নেশা করার ব্যাপারটা আটকাতেই হবে।”
অরিন্দম খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন গাড়ির ড্রাইভার নাকি সে দিন নেশা করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কিন্তু হিরণের ড্রাইভার অবশ্য নেশা করেননি।
বিভিন্ন সঙ্গীত অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা অতনু সরকার বললেন, “বছরে যদি হাজারখানেক অনুষ্ঠান হয়, তা হলে দশ-পনেরোটা দুর্ঘটনা তো বাঁধা।”
এই সব দুর্ঘটনার কারণ কী? অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সমবেত বক্তব্য, “শীতকালে রাস্তাঘাট কুয়াশায় ঢাকা থাকে। সামনে থেকে কোনও গাড়ি এলেও ড্রাইভার অনেক সময় বুঝতে পারেন না। অনেক সময়ই শিল্পী আরোহীকে নিয়ে চলা গাড়ি সময়ের আগে পৌঁছনোর জন্য সামনের
গাড়িকে ওভারটেক করার চেষ্টা করে। শিল্পীরা অনেক সময় বাড়ি থেকে বেরোতে দেরি করেন। তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর জন্য ড্রাইভারকে তাড়া দেন। তাগাদা সামলাতে ঝোড়ো গতিতে গাড়ি চালাতে শুরু করেন ড্রাইভার। ফলে দুর্ঘটনা। এ ছাড়াও ড্রাইভারেরা অনেক সময়ই বিশ্রাম নেওয়ার সময় পান না। সারা রাত গাড়ি চালাবার পর গাড়ির মালিকেরা সকাল আটটায় ফের ডিউটিতে পাঠিয়ে দেন। টানা চব্বিশ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হলে দুর্ঘটনা তো হবেই।”
১৯৯২ সালে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন তাপস পাল। পাণ্ডুয়াতে শো শেষে ফেরার সময় তাঁর গাড়িটা গাছের গুঁড়িতে গিয়ে ধাক্কা খায়। দরজা খুলে মাথার ওপর এসে পড়ে। দারুণ চোট লাগে মাথায়। ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলেই সেই দুর্ঘটনা।
‘সহযাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে
গাড়ি চালালে সাধারণত ড্রাইভারের ঘুম
পায় না। ড্রাইভার যাতে কোনও রকম নেশাভাঙ
করে গাড়ি না চালান সেটা খেয়াল রাখি’
শ্রাবন্তী
‘আমার মতে খুব কুয়াশা পড়লে বা খুব দূরে
শো থাকলে গাড়ি করে রাতে বাড়ি না ফেরাই ভাল।
গাড়িতে আমি জেগে থাকার চেষ্টা করি। যাত্রীরা
ঘুমিয়ে পড়লে ড্রাইভারেরও ঘুম পেতে পারে’
জিৎ
তার পরও তাপস পাল বছরের পর বছর অনুষ্ঠান ও যাত্রা করেছেন।
কোনও সাবধানতা নিয়েছেন কি? উত্তরে তাপস বললেন, “নিয়ম করে দিয়েছি, যে ড্রাইভার আমাকে নিয়ে যাবেন, তাঁকে অনুষ্ঠানের ফাঁকে ঘুমিয়ে নিতে হবে। আর গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুম পেলে কোনও পেট্রল পাম্পে নেমে চোখেমুখে জল দিয়ে চা খেয়ে আবার রওনা হতে হবে।”
অতনু সরকার জানালেন, গত বছর পূজোর সময় ‘মা’ সিরিয়ালের নায়িকা শ্রীতমা ভট্টাচার্য ওরফে ঝিলিক পড়েছিলেন দুর্ঘটনার কবলে। পুজো উদ্বোধন করতে যাওয়ার পথে গাড়ি উঠে যায় ডিভাইডারের ওপর। শ্রীতমা, তাঁর বাবা, গাড়ির ড্রাইভার সকলেই গুরুতর আহত হন। কাছাকাছি নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে তাঁদের শুশ্রূষা করে তুলে দেওয়া হয় গাড়িতে। শ্রীতমা আবার বেরিয়ে পড়েন পুজো উদ্বোধনে। অতনু এও জানালেন, সে দিন শ্রীতমার দু’টি পুজো উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু শ্রীতমার অভিভাবকেরা আরও দু’টি পুজো কমিটিতে মেয়েকে দিয়ে উদ্বোধন করানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কম সময়ে বেশি জায়গায় ঘোরার চাপ থাকলে ড্রাইভারেরা দ্রুত গাড়ি চালাবার চেষ্টা করেন অনেক সময়ই। শ্রীতমাদের দুর্ঘটনা ঘটার কারণ হয়তো বা সেটাই।
বিগত কয়েক বছরে যাঁরা মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শঙ্কর চক্রবর্তী, খরাজ মুখোপাধ্যায়ও। পায়ে সাংঘাতিক চোট পেয়েছিলেন খরাজ। আহত হয়েছিলেন তাঁর ছেলেও। শরীরের নানা অঙ্গে ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে দু’মাস শয্যাশায়ী ছিলেন খরাজ।
‘স্টার’ বলতে যাঁদের বোঝায় প্রসেনজিৎ থেকে ঋতুপর্ণা, দেব, জিৎ, রচনা থেকে শুভশ্রী, শ্রাবন্তী এঁরা যখন শো করতে যান, তাঁদেরও তো প্রতিদিন পেরিয়ে আসতে হয় মরণফাঁদ। “নিরাপত্তার জন্য স্টারদের গাড়ির সামনে বিশেষ রক্ষী সমেত গাড়ি যায়। সেখানে চার জন দেহরক্ষী থাকেন। মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হলে বা অন্য কোনও বিপদ হলে চট করে মোবাইল টিপলেই সিকিওরিটির গাড়ি ঘুরে গিয়ে স্টারের গাড়ির সামনে চলে আসে,” বলছেন অতনু সরকার। তা হলে একটা প্রশ্ন তো ওঠেই যে, বড় তারকাদের জন্য এক ব্যবস্থা
আর অন্যদের জন্য আর এক ব্যবস্থা কেন? প্রাণের মূল্য তো সকলেরই আছে। তার উত্তরে অনুষ্ঠানের আয়োজক তোচন ঘোষ বললেন, “ঋতুপর্ণা, জিৎ, দেব বা শ্রাবন্তীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করলে ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। এঁদেরকে কেন্দ্র করে পান থেকে চুন খসলে জনতা ভেঙে পড়বে রাস্তায়। সেই ধাক্কা সামাল দিতেই অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতে হয়। সকলেরই প্রাণের মূল্য এক, এ কথা স্বীকার করেই বলছি।”

দুর্ঘটনার কবলে
অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় খরাজ মুখোপাধ্যায় হিরণ

কিন্তু শিল্পীরা নিজেরা কে কী সাবধানতা নিচ্ছেন? তাপস পাল ড্রাইভারকে জাগিয়ে রাখার ব্যাপারে যে ভাবে সচেতন, অন্য শিল্পীরা কি ততটা সচেতন? উত্তরে শতাব্দী রায় বললেন, “অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার থাকলে হবে। তাই ভগবানকে স্মরণ করে বেরোনোই একমাত্র উপায়।”
কিন্তু প্রাণটুকু হাতে নিয়ে ঈশ্বর স্মরণ করে পথে বেরোনোর পক্ষপাতী নন আর উদ্যোক্তারা। তাঁদের কথা হল, রাতে যদি দূরপাল্লার শো থাকে তো শিল্পীদের আশপাশের হোটেলে রাখার বন্দোবস্ত করতে চান তাঁরা। এমনকী রাতবিরেতে শো করে বেড়ানো অরিন্দম বা হিরণের মতো শিল্পীরাও চাইছেন নিজের গাড়ি, নিজস্ব ড্রাইভার নিয়ে শো করতে যেতে।
যাঁরা শো করতে যান, তাঁদের পথ-নিরাপত্তার জন্য রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন বিশেষ কোনও বন্দোবস্ত নিয়েছেন কি?
উত্তরে রাজ্যের ডিজি ট্র্যাফিক গৌতমমোহন চক্রবর্তী বললেন, “হাইওয়ের ধারে ধারে আমরা পুলিশ চৌকি বসিয়েছি। যাতে কোনও গাড়ি দ্রুত ড্রাইভ করে বা ওভারটেক করে বেরিয়ে যেতে না পারে। যাঁরা শো করতে চলেছেন, তাঁরা কোনও সময়ই যাতায়াতের পথে নিরাপত্তার জন্য আমাদের কাছে সাহায্য চান না। সাহায্য চাইলে আমরা সহযোগিতা করবই।”
শেষ কথা একটাই। অনুষ্ঠানের আয়োজক আর শিল্পীরা কি আরও বেশি সচেতন হবেন শো করে ফেরার পথে? না কি নিয়তির ওপর ছেড়ে দেবেন সবটা?
একটু সতর্ক থাকলেই কিন্তু এই সব দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.