হোটেল ব্যবসায়ী ৫৩ বছরের গুরমুখ জেঠওয়ানি ১৯৯৪ সাল থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তার সঙ্গে স্থূলতার সমস্যা। সিঙাড়া, ভুজিয়া, উত্তাপাম, মিষ্টি, ঘি-- কোনও কিছুতেই লোভ সামলাতে পারেন না। এক সময় তাঁর ওজন গিয়ে দাঁড়ায় ১২০ কিলোতে। নড়তে-চড়তে পারেন না। রোগা হওয়ার নামী ক্লিনিকে নাম লেখালেন। তারপর লাইপোস্যাকশন অপারেশন করে শরীরের মেদ বার করলেন। তাতেও টেনেটুনে ৪-৫ কেজি কমল। গত বছরের অগস্টে ‘ডায়বেটিক সার্জারি’ করালেন। গুরমুখের কথায়, “ছ’মাসে ১২০ কেজি ওজন কমে দাঁড়াল ৮০-কেজিতে। এখন আর সিঙাড়া-ভুজিয়া দেখলেও আমার খেতে ইচ্ছা করে না।” |
নিউ আলিপুরের প্রতীক চৌধুরীর জাহাজ মেরামতের ব্যবসা। ৪৪ বছরের প্রতীক ২০০১ ওই একই রোগে আক্রান্ত। খেতে ভালবাসেন, বিশেষ করে মিষ্টি। ওজন গিয়ে দাঁড়ায় ১১৭ কেজিতে। প্রায় বছর দুই আগে ডায়াবেটিক সার্জারি করিয়ে ওজন নামিয়েছেন ৭২ কেজিতে। এখন খাওয়াদাওয়ায় ভীষণ সতর্ক তিনি।
গুরমুখ-প্রতীকের মতো অনেকেই শনিবার বিকেলে হাজির হয়েছিলেন ‘ডায়বেটিক সার্জারি’ সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায়। এসেছিলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। ‘টাইপ-১’ ডায়াবেটিসে রোগীদের দেহে ইনসুলিন তৈরি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ‘টাইপ-২’ ডায়াবেটিসে তা হয় না। এঁদের শরীরে প্রচুর ইনসুলিন থাকে। কিন্তু অন্ত্রে প্রচুর ফ্যাট জমে থাকায় ইনসুলিন কাজ করতে পারে না, বা শরীরে একটা ইনসুলিন-প্রতিরোধ তৈরি হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী ওবেসিটি বা অত্যাধিক ওজন বৃদ্ধির সমস্যায় ভোগেন। ‘ডায়াবেটিক সার্জারি’-র মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের পাশাপাশি রোগীদের ওজনও নিয়ন্ত্রিত হয় বলে দাবি চিকিৎসকদের একাংশের।
সেটা কী ভাবে তার ব্যাখ্যা দিয়ে চিকিৎসক তাপস চক্রবর্তী জানান, এই অস্ত্রোপচারের প্রথম ধাপে ক্ষুদ্রান্তের নীচ থেকে প্রায় ১৭০ সেন্টিমিটার অংশ কেটে খাদ্যনালীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ক্ষুদ্রান্তের এই অংশেই জিএলপি এনজাইম থাকে। এটি অগ্ন্যাশয়ের কোষকে উত্তেজিত করে। ফলে বেশি করে ইনসুলিন ক্ষরণ হয়।
হজম হওয়ার প্রথম পর্বে এই এনজাইম খাবারের সঙ্গে মিশলে ইনসুলিন ভাল ভাবে শরীর থেকে বের হতে পারে, ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ সুরেন্দ্র উগালে জানান, অস্ত্রোপচারের দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগীর ওজন কমানোর ব্যবস্থা হয়। পাকস্থলীর একটা অংশ থেকে একধরনের খিদে বাড়ানোর হরমোন বার হয়। অস্ত্রোপচার করে পাকস্থলীর সেই অংশটা কেটে বাদ দেওয়া হয়। ফলে খিদে কম পায়। আবার ওই হরমোনই শরীরে ইনসুলিন ক্ষরণ কমানোর জন্য দায়ী। ফলে ওই হরমোন ক্ষরণ বন্ধ হলে বা কমলে ইনসুলিনের কার্যকারীতা বাড়ে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
তাপসবাবু ও সুরেন্দ্রবাবুর কথায়, ১৮ থেকে ৭০, যে কোনও বয়সে এই অস্ত্রোপচার হতে পারে। খরচ মাথাপিছু প্রায় ৪-৫ লাখ। অস্ত্রোপচার বিফল হওয়ার সম্ভাবনা ৫%।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বা এন্ডোক্রিনোলজিস্টেরা অবশ্য দাবি করেছেন, এগুলি সবই প্রচলিত বেরিয়াট্রিক সার্জারিরই নানা রূপ। চিকিৎসক সুজয় মজুমদার যেমন বলেন, “এটা ঘুরিয়ে নাক দেখানো। তিন-চার রকম ভাবেই এখন বেরিয়াট্রিক সার্জারি হয়।
তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস-এ এই ধরনের অস্ত্রোপচার বেশ ফলদায়ী। এতে রোগীর ডায়রিয়া বা শারীরিক দুর্বলতার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।” এন্ডোক্রিনোলজিস্ট শুভঙ্কর চৌধুরী আবার বলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অস্ত্রোপচারের পরেও রোগীর বেশি খাওয়ার স্বভাব কমে না এবং আবার শরীরে ফ্যাট জমে। অনেক ক্ষেত্রে আবার অস্ত্রোপচারের ফলে রোগীর নিউট্রিশন ডেফিশিয়েন্সি এবং মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।” |