|
|
|
|
বিনোদন: সেন্সর বিতর্কে কাঙাল মালসাট |
|
পরিবর্তনেও স্তালিনের শোকে ফ্যাতাড়ুতে কোপ
ইন্দ্রনীল রায় • কলকাতা |
|
স্তালিনের প্রতি অসম্মানসূচক মন্তব্য রয়েছে বলে অভিযোগ। তাই সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশনের কলকাতা অফিস একটি বাংলা ছবির সার্টিফিকেশন আটকে দিয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে গুঞ্জন, বাম আমল হলেও না-হয় কথা ছিল! কিন্তু পরিবর্তনের জমানায় খামোখা স্তালিনকে নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? এক দল ফুট কেটে বলছেন, এ যেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি! অন্য দলের বক্তব্য, স্তালিন তো উপলক্ষ মাত্র! আসল কারণটা...।
সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কাঙাল মালসাট’ ছবিটা নিয়ে অতএব জোর বিতর্ক!
নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্প অবলম্বনে বানানো এই ছবিকে ‘রিফিউজাল অফ সার্টিফিকেট’ দিয়েছেন সেন্সর কর্তৃপক্ষ। ভাগ্য নির্ধারণের জন্য ছবিটি পাঠানো হয়েছে ফিল্ম সার্টিফিকেশন অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল (এফসিএটি)-এ। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, প্রধান সমস্যা বেধেছে ছবির তিনটি অংশ নিয়ে। যেখানে সিঙ্গুরে টাটা-বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক দৃশ্য রয়েছে। সরকারি কমিটি নিয়ে কটাক্ষ রয়েছে। সেন্সরের আপত্তি তাই নিয়েই। পাছে বিষয়টা একপেশে দেখতে লাগে, তাই স্তালিন-প্রসঙ্গ নিয়েও আপত্তি তুলে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ। ছবিতে গালাগালির প্রাচুর্য নিয়েও আপত্তি উঠেছে। সেন্সরের কমিটিতে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বেশির ভাগই শাসক দলের কাছের লোক বলে পরিচিত। সুতরাং রাজ্য সরকারের অপছন্দের কোনও কথা যাতে ছবিতে না থাকে, সেটাই তাঁরা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন বলে মনে করছেন ইন্ডাস্ট্রির অনেকে। |
|
ছবিতে দণ্ডবায়স চরিত্রে কবীর সুমন। —নিজস্ব চিত্র |
সেন্সরের রিভাইজড কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন হরনাথ চক্রবর্তী। প্রভাত রায়, মনীশ মিত্ররাও ছিলেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে হরনাথ ছবিটি নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা গোপন করেননি। তিনি বলেন, “টাটা কোম্পানি, দিদির শপথগ্রহণ এগুলো গল্পে ছিল না। সুমন কেন ওগুলো রাখল, বুঝছি না।” কিন্তু চলচ্চিত্র-অনুরাগীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন গল্পের চেয়ে সিনেমা বহু ক্ষেত্রেই বদলে যায়, বদলে ফেলা হয়। পরিচালক গল্পের সঙ্গে অনেক কিছু জোড়েন, অনেক কিছু বাদও দেন।
বিভূতিভূষণের উপন্যাস থেকে ‘অপু ট্রিলজি’ তৈরির সময় যেমন সত্যজিৎ রায় নানা রকম বদল ঘটিয়েছিলেন। লীলা চরিত্রটি বাদ গিয়েছিল, আবার অপুর বন্ধু পুলু-র চরিত্রটি অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। সে ব্যাপারে সত্যজিৎ অনেক স্বাধীনতাও নিয়েছিলেন। ‘কাঙাল মালসাটে’ কেন নতুন নতুন প্রসঙ্গ ঢুকল, সেন্সরের রিভাইজড কমিটি তাই নিয়ে সুমনকে প্রশ্ন করেছিল। সুমন জানাচ্ছেন, “আমি বলেছিলাম, আমি তো গল্প অবলম্বনে ছবিটা করেছি। গল্পে সব কিছু থাকতে হবে কে বলেছে? ফিল্মমেকার হিসেবে আমি তো গল্পটা কনটেম্পোরারি করবই!” হরনাথ নিজে এক জন পরিচালক হয়ে গল্পে রদবদল নিয়ে আপত্তি করলেন কেন? হরনাথের জবাব, ‘‘কেন আপত্তি তোলা হয়েছে, সেটা ছবিটা দেখলেই বুঝতে পারবেন। একটা ছবি যদি আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা তৈরি করে, তার দায়িত্ব কে নেবে?”
হরনাথের যুক্তি মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই ছবিটাকে রিফিউজাল অফ সার্টিফিকেট দিয়েছেন এখানকার রিজিওনাল সেন্সর অফিসার। যদিও ইন্ডাস্ট্রির অনেকেরই অভিযোগ, সেন্সর অফিসের নিজস্ব ভূমিকা এখানে খুব বড় নয়। তাঁদের দাবি, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ যাঁরা কমিটিতে রয়েছেন, তাঁরাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সেন্সর বোর্ডকে ব্যবহার করে ছবি আটকানোর চেষ্টা করছেন। “এটা গণতন্ত্রবিরোধী। আগে বাম জমানাতেও একই জিনিস ঘটেছে। এখানেও তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে,” বলছেন অপর্ণা সেন। হরনাথ এই অভিযোগ মানতে রাজি নন। তাঁর দাবি, “রাজনৈতিক চাপের কোনও প্রশ্নই নেই। যেখানে যা আপত্তি তোলার, সেটা সেন্সরের আইন মেনেই তোলা হয়েছে।” |
|
ছবিতে অভিনয় করেছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। |
যেমন? সেন্সরের রিভাইজড কমিটি সুমনের ছবিতে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে নাগরিক সমাজের আন্দোলনকে অসম্মান করা হয়েছে বলে দাবি করেছে। অপর্ণা নিজে ওই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন, সুমনের ছবিটিও দেখেছেন। তাঁর কথায়, “আমি সিঙ্গুরের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমেছিলাম। কিন্তু সিনেমায় তার রেফারেন্স নিয়ে আপত্তি হবে কেন? আপনার খারাপ লাগলে আপনি দেখবেন না ছবিটা।” অপর্ণা মানছেন, ছবিতে গালাগালি আছে। “কিন্তু যে শ্রেণির মানুষকে সুমন দেখিয়েছে, তাঁরা ওই ভাবেই কথা বলেন। আমারও খুব শকিং লেগেছিল। কিন্তু অ্যাম লিবারাল এনাফ টু অ্যাকসেপ্ট দ্যাট।”
সেন্সর-কর্তারা তবে এতটা বিচলিত হলেন কেন? ছবিতে দন্ডবায়স চরিত্রে অভিনয় করা কবীর সুমনের সংলাপ রয়েছে, “দেখলি টাটারা পর্যন্ত ধেড়িয়ে গেল এখানে এসে! শুনলাম এখন নাকি ভিতরে ভিতরে কী সব হয়েছে। কী সব কমিটি-ফমিটিতে বসে। কলকাতাকে নাকি লন্ডন বানাবে! বলদ কোথাকার!” আর একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, একটি চরিত্র রীতিমতো বিতৃষ্ণা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথ অনুষ্ঠান দেখছে টিভির পর্দায়। দু’টি ক্ষেত্রেই আপত্তি তুলেছে সেন্সর। তাদের বক্তব্য, “টাটা-বিদায় নিয়ে যে ভাবে মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে নাগরিক সমাজের আন্দোলনকে হেয় করা হয়েছে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের দৃশ্যটি যে ভাবে রাখা হয়েছে, তাতে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে। বহু মানুষের মনে তা আঘাত করতে পারে, উত্তেজনা ছড়াতে পারে।”
আর স্তালিন? সিনেমায় আছে স্তালিন পার্টি লিডারকে বলছেন, “কতগুলোকে মারলাম। নামের লিস্ট আসত! নামের পাশে লিখতাম, ‘ফর এগজিকিউশন’। এক বার দু’বার নামের পাশে শুধু ‘টু দ্য ক্যাম্পস্’ লিখেছিলাম।” সংলাপটি নিয়ে সেন্সর অফিসের বক্তব্য, “ছবিতে স্তালিনের উপস্থাপনা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে করা হয়েছে। এ রকম একপেশে সংলাপ বহু স্তালিনপন্থীর ভাবাবেগে আঘাত করবে! ছবিটি দেখালে এই নিয়ে হাঙ্গামাও হতে পারে।”
স্তালিন নিয়ে ভাবাবেগের প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়েছে, ক’বছর আগে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ‘টরাস’ ছবিটি দেখানো নিয়ে সমস্যার কথা। আলেকজান্দার সকুরভ পরিচালিত সেই ছবিতে লেনিনের উপস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ছবিটি দেখানোর বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমেছিল কিছু বাম সংগঠন। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে ছবিটি দেখানো হয়। বাম-ঘনিষ্ঠ অভিনেতা বাদশা মৈত্র বলেন, “সিপিএম আমলে সব ঠিক ছিল, তা নয়। কিন্তু এই সরকার রোজই অসম্ভব অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছেন।”
পুরো ঘটনাটায় বিরক্ত পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ও। তিনি জানান, ছবিটি ডিসেম্বরে সেন্সর সার্টিফিকেটের জন্য জমা দেওয়া হয়। প্রথম কমিটি ছবিটি দেখার পর সেটাকে রিভাইজড কমিটির কাছে পাঠায়। “রিভাইজড কমিটিতে ছিলেন হরনাথ চক্রবর্তী, প্রভাত রায়, মণীশ মিত্র-রা। তাঁরা ছবিটির চারটে জায়গা নিয়ে আপত্তি তোলায় এখন ট্রাইব্যুনালের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমি বলেছি, ফিল্মের কোনও অংশ কাটব না।”
সুমনের বয়ান অনুযায়ী, রিভাইজড কমিটির সঙ্গে কথোপকথনে প্রথমে ওঠে ছবিতে গালাগালির প্রসঙ্গ। সুমনের বক্তব্য, ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ বা ‘২২শে শ্রাবণ’য়েও গালাগালি ছিল। আর ‘কাঙাল মালসাটে’র ফ্যাতাড়ুরা যে শ্রেণির মানুষ, তারা ওই ভাষাতেই কথা বলেন। তার পর প্রশ্ন ওঠে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটা এক জন বিতৃষ্ণার চোখে কেন দেখছেন? সুমনের জবাব, “এটা গণতন্ত্র। কেউ যদি উল্লসিত না হয়, সেটা তার অধিকার।” এতেই শেষ নয়। “হরদা আমায় বলেন, আপনি বলেছেন সব ‘বলদে’রা কমিটিতে বসেছে। কিন্তু কমিটিতে তো বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বও আছেন।” হরনাথ আনন্দবাজারকে ফোনেও বলেন, “কমিটিতে সবাই ‘বলদ’ বলা নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিল। মানুষের মনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে বাধ্য।” সুমনের দাবি, মনীশ-প্রভাত-হরনাথরা প্রশ্ন করেছিলেন, কলকাতাকে লন্ডন বানানো হবে এই প্রসঙ্গই বা কেন তোলা হয়েছে ছবিতে। “লন্ডন বানানোর কথা শুনে এক জন হাসে, এমনটাই ছিল ছবিটাতে। তাতেই ওঁদের আপত্তি। আমি বলি, কেউ যদি হাসে তাকে আপনি আটকাবেন কী করে?” হরনাথ বলছেন, “আমরা তো ছবিটা আটকাইনি। ট্রাইব্যুনাল যদি আপত্তি না করে, তা হলে ছবিটা যেমন আছে, তেমন ভাবেই মুক্তি পাবে!”
‘চলো পাল্টাই’-এর পরিচালক উদাহরণ দিচ্ছেন, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে নতুন কথা বসানো নিয়ে আপত্তি করেছিল সেন্সর কমিটি। রিভাইজড কমিটি-র মনে হয়েছিল, ভূতেদের গানে এই স্বাধীনতা নেওয়া যেতেই পারে। ফলে সমস্যা মেটে। “আমাদের আপত্তি মেনে সুমন ওঁর ছবি পরিবর্তনে রাজি ছিলেন না। ফলে ছবিটা ট্রাইব্যুনালে গিয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ওঁরাই নেবেন! এটাই তো নিয়ম!”
বাম আমলে সুমনের প্রথম ছবি ‘হারবার্ট’ নন্দনে দেখানোর ব্যাপারে এক প্রস্ত বাধা পেয়েছিল। পরিবর্তনের পরে বাধা এল সেন্সর-পর্বেই। সুমন অবশ্য পরবর্তী পদক্ষেপ ভেবে রেখেছেন। বললেন, “ইন্টারনেটে বিভিন্ন মুভি সাইট আছে। যদি ‘কাঙাল মালসাট’ রিলিজ করতে না-ই দেওয়া হয়, সেখানেই ছবিটা দেখাব আমরা।” |
|
|
|
একটি চিত্র প্রদর্শনীর সূচনায় মুনমুন সেন, সঙ্গে শিল্পী
সুনীতা কুমার। শনিবার, মিডলটন স্ট্রিটে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক |
তারকার হাসি: ছবির প্রচারে সোনাক্ষী সিংহ।
মুম্বইয়ের বান্দ্রায়। ছবি: পিটিআই |
|
|
|
|
|
|
|