|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
কেবল প্রশ্নার্ত নয়, প্রসন্নও |
আশিস পাঠক |
ফোটোগ্রাফিং ইন্ডিয়া, সুনীল জানা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস ইন্ডিয়া, ৩৯৯৫.০০
বাংলাদেশ: দ্য প্রাইস অব ফ্রিডম, রঘু রাই। নিয়োগী বুকস, ১৪৯৫.০০
মাই জার্নি অ্যাজ আ উইটনেস, শহিদুল আলম। স্কিরা ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, মূল্য অনুল্লেখিত |
আই অ্যাম আ ডিফাংট ফোটোগ্রাফার। লেট’স ফেস ইট।’ প্রায় কুড়ি বছর আগে এক আলাপচারিতায় কিরণময় রাহাকে কথাগুলো বলেছিলেন সুনীল জানা। তখনই তিনি দীর্ঘ দিনের দেশছাড়া। আদৌ বেঁচে আছেন কি না তা নিয়েও ঘনিষ্ঠজন আর বিশেষ রসিকেরা ছাড়া কেউ ভাবিত নন। আর আজ, প্রবাসে তাঁর মৃত্যুর মাসসাতেক পরে? তাঁর বই দ্য সেকেন্ড ক্রিচার, ডান্সেস অব দ্য গোল্ডেন হল বিস্মৃত এবং বিলুপ্ত। টিমটিম করে টিকে আছে ট্রাইবালস অব ইন্ডিয়া। যে বই তাঁকে প্রচারিত করেছে, সেই সঙ্গে আড়ালও করেছে তাঁর প্রতিভার সমগ্রতাকে।
১৯৪০ থেকে ১৯৭০—এই তিন দশকের ভারতবর্ষ কিংবা ভারতের রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, শিল্প, উদ্বাস্তুর স্রোত, বামপন্থী আন্দোলন, সংস্কৃতির নানা ধারা সবে মিলে সেই সমগ্রতা। তারই ‘ডিসাইসিভ মোমেন্ট’গুলি সাদা-কালোয় ধরেছিলেন ‘ফোটোকওয়ালা’ সুনীল। প্রবাসে, দৈবের বশে, তার সবটাই দেখার আড়ালে চলে যাচ্ছিল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রকাশনায় সে সবই প্রকাশিত হতে চলেছে ফোটোগ্রাফিং ইন্ডিয়া নামে। বইয়ের যে প্রিভিউ কপিটি হাতে এসেছে তার একটি ছবি স্বয়ং আলোকচিত্রীর। গোটানো প্যান্ট, খালি গায়ের পরিব্রাজক সুনীল জানা কলের তলায় ছবি ওয়াশ করছেন। ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, পথে নেমেই পথ চেনার এই ঐতিহ্য ভারতীয় ফোটোগ্রাফির আজকের উজ্জ্বল তারকাবৃত্তে কিছুটা যেন নিষ্প্রদীপ হয়েই থাকে। |
|
জনসমুদ্রে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ছবি: রঘু রাই |
‘হিস্ট্রি’ আর ‘ল্যান্ড অ্যান্ড ইটস পিপল’, এ বইয়ে এই দুটি মূল ভাগে বিভক্ত সুনীল জানার ভারত। প্রথমটির উপবিভাগ চারটি— দ্য লিডার্স, ফেমিনস, রায়টস অ্যান্ড রিফিউজিস, মুভমেন্টস। পরেরটির সাতটি— ভিলেজেস, ট্রাইবালস, ইন্ডাস্ট্রিজ, সিটিজ, আর্কিটেকচার, ক্লাসিক্যাল ডান্স, পোর্ট্রেটস। ছাতের পড়ার ঘরে জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আসা আলোর জ্যামিতি ক্যামেরায় ধরা দিয়ে যাঁর আলোকচিত্রী জীবনের শুরু তাঁকে ভারতের পথে নামিয়েছিলেন পূরণচাঁদ যোশি। বামপন্থী আন্দোলনের শরিক হিসেবে বাংলা-ওড়িশা-অন্ধ্রের দুর্ভিক্ষ তো বটেই, দাঙ্গা আর উদ্বাস্তু মিছিলের বহু ছবি তুলেছেন তিনি। কিন্তু সে সব নিছক ইতিহাস ধরে রাখা নয়, ইতিহাস সৃষ্টি করা। বিপন্ন সেই জীবনের বেশির ভাগ ছবিই ফিরে দেখলে বোঝা যায়, ক্যামেরার পিছনে সুনীলের চোখ ভিড়ের মধ্যেও খুঁজে বেড়িয়েছে কোনও একটি মুখকে, যে মুখ পরম যন্ত্রণার। কিংবা কোনও চরম প্রশ্নেরও, অনুচ্চারিত যে-প্রশ্ন মুখোমুখি বিঁধতে থাকে সংস্কৃতিপরায়ণ, তর্কমুখর আমাদের। সেই প্রশ্নটা রেখে যায় বলেই নিছক চিত্রসাংবাদিকতা ছাড়িয়ে তাঁর ছবি আজও স্মরণযোগ্য হয়ে আছে।
দেশভাগ আর দাঙ্গা-সম্পর্কিত ছবিতে ওই প্রশ্ন বিদ্ধ করে বিস্মৃত এক ভারতীয় আলোকচিত্রীর সমগ্রে। তারই পাশে এখনও চরম উদ্যাপিত এক তারকা-আলোকচিত্রীর সাম্প্রতিকতম বইটিতে প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় আরও তীব্রতায় যেন ওই আর্ত প্রশ্নটাই ফিরে আসে। রঘু রাইয়ের বাংলাদেশ: দ্য প্রাইস অব ফ্রিডম বাংলাদেশের সেই প্রশ্নার্ত, রক্তাক্ত জন্মের চিত্রকাহিনি। কত মানুষ মরলে আর বানের জলে ভেসে গেলে স্বাধীনতা আসে, আবহমান সেই সাদা-কালো প্রশ্নটা এ বইয়ের মূল সুর। দীর্ঘ দিন এই ছবিগুলি হারিয়েছিল ভুলে যাওয়ার অন্ধকারে। |
|
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় রাতের অন্ধকারে নৌকো করে
নোয়াখালি ছেড়ে যাচ্ছেন গ্রামবাসীরা, ১৯৪৬-’৪৭। ছবি: সুনীল জানা |
১৯৭১-এ বনগাঁ সীমান্ত থেকে উদ্বাস্তু মিছিলের সঙ্গী হয়েছিলেন রঘু। পথের সেই দুঃসহ জীবন আর তার শৈশব-কৈশোর-বার্ধক্য ভিড়ের মাঝে, ইতিহাসের মহাফেজখানায় হারিয়ে থাকেনি কেবল রঘু রাইয়ের ক্যামেরার জোরে। অগস্টের ভরা বর্ষায় সেই দুঃসহ যাত্রার সঙ্গী হয়েছিল ক্যামেরা। তার পরে যে বিবর্ণ জীবন ফুটে উঠল আন্তরিক, মানবিক অথচ প্রোফেশনাল সেই ডার্করুমে তার প্রায় প্রত্যেকটিকে আলোকিত করেছে দু’একটি তীব্র, অসহায় দৃষ্টি। নিশ্চিন্তপুরের জীবনের শিকড়টি রাজনীতির হ্যাঁচকা টানে উপড়ে গেল যখন তখন গরুর গাড়িতে আরও এক হরিহর, সর্বজয়া, অপু, এমনকী দুর্গাও। কোনও মতে জীবনের সম্বলটুকু ছাতা দিয়ে ঢেকে রাখছেন মিছিলের সেই একটি জীর্ণ মুখ। কিংবা পোর্ট্রেটে নিবিড় অন্ধকারের পটে কাপড়ের খুঁটে চোখের জল মুছছেন এক বৃদ্ধা, বলিরেখাময় কপাল তাঁর, একটি চোখ খোলা। আর একটি, প্রায় সমান ক্লোজ আপে, খিদের জ্বালায় একটি শিশুর তীব্র চিত্কার, ঠিকরোনো জলভরা দুচোখে তীব্র রাগ। বইটির পরের পর্বে ভারতীয় সেনাবাহিনির মুক্তিযুদ্ধযাত্রা। সেখানে মৃত্যুর মিছিল, লড়াইয়ের উত্সাহ। আর শেষ দু’চারটি ছবিতে ওই ভীষণ মূল্যের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার উদ্যাপন, জোয়ার লাগা জনসমুদ্রে।
রঘুর বইয়ের এই শেষ পর্বটির নাম ‘রিবার্থ অ্যামিড ব্লাডশেড’। কিন্তু ১৯৭১-এ জন্ম হল যে রাষ্ট্রের, গত চার দশকে কেমন করে বড় হয়ে উঠল সে? সেই ইতিহাস শহিদুল আলমের বইটির প্রধান অংশ। কেবল ঘটনা আর অঘটনের সাক্ষ্য নয়, পটে আঁকা আপাতশান্ত ছবিটির মতো যে ইতিহাস বয়ে চলে বাংলাদেশের দৈনন্দিনে শহিদুলের ক্যামেরা বার বার চোখ খুলেছে তারও সামনে। |
|
বয়স্ক শিক্ষা, সইদপুর। ছবি: শহিদুল আলম |
বার্তার যে তীব্রতা রঘুর বইটির প্রায় সব ছবিতে, এ বইয়ের অধিকাংশে তা অনুপস্থিত। আসলে তীরে দাঁড়িয়ে জীবনকে দেখা, ঘাটের কাছে নদীর জলের গল্প শোনার শান্ত ভঙ্গিটাই যেন অন্তত এ বইয়ে শহিদুলের নিজস্ব ভাষা। বাংলাদেশে ফোটোগ্রাফি আন্দোলনের পুরোধা শহিদুল সেই ভাষায় বার বার প্রকাশ করেছেন তাঁর ভুবন-ভ্রমণকে, কিন্তু যখন তিনি বাংলাদেশে তখন তাঁর ক্যামেরায় নিজের জীবন, বীজের জীবনের এক নতুন কবিতা তৈরি হয়। নকশাল সিরিজের ছবিগুলি, বন্যার ছবিগুলি এবং কুতুবদিয়ার হাসপাতালে কলেরা-আক্রান্ত কিশোর-কোলে মানুষটির ছবিতেও সেই কবিতাই, যাকে কোনও দিনই শিল্প ছুটি দিতে পারে না। তাঁর ক্যামেরায় মানুষের চোখ তাই কেবল প্রশ্নার্ত নয়, প্রসন্নও।
সেই প্রসন্নতাটুকু নিশ্চয় যাবজ্জীবন, কিন্তু তার চেয়েও শাশ্বত অসহায় ওই দৃষ্টিগুলির অনুচ্চারিত প্রশ্নটা। প্রশ্নটা কী? নিজের বইয়ের ভূমিকায় রঘু লিখছেন, ‘কয়েক দিন পরে আমার তিন বছরের ছেলের পাশে বসে ছবিগুলো দেখছিলাম। বেদনার্ত মুখে সে আমায় প্রশ্ন করল, ‘কেন’?’
ওই প্রশ্নটার মধ্যেই, বই তিনটি, ধরে রেখেছে প্রতিবেশি দুই রাষ্ট্রের ইতিহাস। আর এক রকম ইতিহাস। |
|
|
|
|
|