ওই মেলটা আমি করিনি। প্লিজ, ওটা পাত্তা দিস না। আমার মেল আই ডি হ্যাক্ড হয়েছে।”
ফোনের ও ধারে একরাশ উৎকণ্ঠা ভরা অভিরূপের গলা। শুনে পুরো আকাশ থেকে পড়ল সুমিত।
দু’দিন ধরে ওর ঘাম ছুটে গিয়ে ছিল ইতালি থেকে অভিরূপের মেল পেয়ে, “এখনই তিন হাজার ইউরো পাঠিয়ে দে। খুব বিপদে পড়েছি। নীচে একটা অ্যাকাউন্ট নম্বর দিলাম। ফোনটা কাজ করছে না। তাই লাইন
পাবি না।”
কোথায় পাবে অত টাকা! কী-ই বা হল অভির। ভাবতে ভাবতেই এক দিন কেটে গেল। তার মধ্যেই ওই ফোন। অভিরূপ বলল, “শুধু তোকে নয়, খবর পেলাম হ্যাকার অনেককে মেল করেছে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে। ফোন খারাপ মিথ্যে কথা। মেল পেয়ে জোর করে একজন ফোন করেছিল। তাতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।’
শুধু ইতালির অভিরূপ নয়, এই হ্যাকিংয়ের ফাঁদ এখন ভুবন জোড়া। এই কলকাতাতেও। কয়েক দিন আগের কথা। বাড়ির লোকজনের সঙ্গে শপিং মলে ঘুরছিলেন সুনীল।
মোবাইল পরিষেবা দেওয়া এক সংস্থার মোনোগ্রাম করা টুপি পরে এক তরুণ এগিয়ে এল তাঁর কাছে। হেসে জানাল, তাদের সংস্থা একটা প্রোমোশনের কাজ করছে। তাতে ডেবিট কার্ড সোয়াইপ করে ৫০ টাকা দিলেই ২৫০ টাকার ফ্রি রিচার্জ দেওয়া হবে।
খুশি মনেই রাজি হয়ে গেলেন সুনীল। কার্ড সোয়াইপ করে দিয়েও দিলেন টাকা। আরেক ক্রেতা মুরলী তা দেখে এগিয়ে এলেন। আর তিনিও অফারটি শুনে নিজের কার্ড সোয়াইপ করলেন। কয়েক ঘণ্টা পরে দুজনেই টের পেলেন তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে বেশ বড়সড় পরিমাণ টাকা উধাও হয়ে গিয়েছে।
গত অগস্টে তৃণমূল কংগ্রেসের ওয়েবসাইটও ‘হ্যাক্ড’ হয়। আর তারপর সেখানে পোস্ট করে দেওয়া হয়, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কোট’, তিনি ছিলেন একজন মাওবাদী।
এ মাসেরই ঘটনা। মুকেশ মাথুর নামে এক ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কর্মীর। ভদ্রলোক একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করেন, বহু বার তাঁর কার্ড ব্যবহার করে ৪৫ হাজার টাকা চুরি করা হয়েছে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে। যদিও ‘সিকিওর্ড সাইটে’ বিল মেটানো ছাড়া নিজের কার্ড কখনওই ব্যবহার করেননি তিনি। |
আরেক ভদ্রলোক পরাগ বিদ্যার্থীরও একই অভিজ্ঞতা। তাঁর অজ্ঞাতেই এইচএফসি ব্যাঙ্কের তাঁর ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ৪২ হাজার ৪৯ টাকার শপিং করা হয়েছে এক অনলাইন শপিং সাইটে।
একটি ঘটনায়, পুলিশের সাইবার সেলের প্রায় এক বছর লেগেছিল অপরাধীকে ধরতে। তাঁরা যাঁদের ধরেন, তাদের মধ্যে দু’জন ছিল ওয়েব ডেভলপার। তারা এমন কিছু যন্ত্র তৈরি করে, যাতে অন্যের এটিএম পিন চুরি করা যায়। বহু এটিএম-এ স্পাই ক্যামেরাও বসিয়েছিল তারা। লক্ষ্য ওই একই, পিন চুরি করা।
এই সব যন্ত্র দিয়ে তারা ৪-৫ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলে বিভিন্ন কার্ড-হোল্ডারের অ্যাকাউন্ট থেকে। সাইবার সেলের লোকজন খেয়াল করেন, সেই সব কার্ড-হোল্ডার প্রত্যেকেই এক অদ্ভুত দোষে দুষ্ট। এঁরা কেউই নিজেদের কার্ডের দিকে তেমন নজর রাখেন না। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা এই চক্রের কবলে পড়ে। তাঁদের কেউ দিল্লি বা কলকাতার, কেউ আবার হায়দরাবাদ, নাগপুর, ভুবনেশ্বর, চণ্ডীগড়, বেঙ্গালুরু-র মতো শহরের লোকজন।
এই রকম হ্যাকিংয়ের উদাহরণ কিন্তু প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। টেকনোলজির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই আরও বেশি করে ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়ছি। ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে হ্যাকাররা। হ্যাকিংয়ের আসল কারণ অবশ্যই টাকা হাতানো। কিন্তু তথ্য পাওয়া আর সেই তথ্য থেকে ফায়দা তোলাও থাকে হ্যাকিংয়ের পিছনে।
এই যেমন আমরা অনেকেই ব্রডব্যান্ডের জন্য ওয়াই-ফাই ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করি। ঠিকঠাক মতো সতর্ক না হলে হ্যাকাররা কিন্তু চাইলেই আপনার বা আমার সেই ওয়াই-ফাই ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে। আর তার মূল্য দিতে হবে আমাকে-আপনাকে। এই ব্যাপারটি থেকে বাঁচতে সহজ একটা উপায় আছে। যাঁকে দিয়ে আপনার নেটওয়ার্ক ‘ইন্সটল’ করিয়েছেন, তাঁকে বলবেন, আপনার নেটওয়ার্কটি যেন লুকোনো থাকে। এবং সেটি যেন ডব্লিউপিএ ২ হয়।
কখনই ডব্লিউইপি ব্যবহার করবেন না। ওটা সহজেই হ্যাক করা যায়।
যখন আপনার নেটওয়ার্ক লুকোনো থাকে তখন আপনার নেটওয়ার্কের নাম শুধু আপনিই জানবেন। ওয়্যারলেস মোডেমের ‘ডিফল্ট পাসওয়াডর্’ বদলে কোনও অন্য পাসওয়ার্ড দিয়ে দিন। এই সব ক’টি ব্যাপারেই অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত কারও সাহায্য নিন।
এ বার আসা যাক কম্পিউটার আর ফোনে। দু’টোই তো সব সময় অনলাইন থাকে। সেখান থেকেই হয় ‘আইডেনটিটি থেফ্ট’। আইডেনটিটি থেফ্ট মানে যখন কেউ আপনার নাম, প্যান নম্বর বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর আপনার অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করে।
এগুলো ঠেকাতে প্রথম ধাপটি হল, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কোনও ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না। সাবধান থাকবেন ফেসবুকে অ্যাপস্ বা অ্যাপ্লিকেশন (অর্থাৎ গেমস, বার্থ ডে রিমাইন্ডার বা এই ধরনের অন্য কোনও ব্যাপারস্যাপার) ব্যবহারের সময়ও।
প্রায় সব অ্যাপস্ই ইন্সটল করার সময় কনট্যাক্ট লিস্ট, ফোটো বা অন্য কোনও তথ্য আপনি জানাতে রাজি কি না সেটা জানতে চায়। এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলুন। অর্থাৎ এ ধরনের কোনও তথ্য দেবেন না। যদি না অ্যাপসের ব্যাপারে একশো শতাংশ নিশ্চিত না হন।
কম্পিউটার থেকেও আপনার তথ্য চুরি হতে পারে। তাই পিসিতে কোনও ভাল ‘ফায়ারওয়াল’ ইন্সটল করুন। আর সেটার সেটিংটাও ঠিকঠাক করে নিন। অ্যান্টি ভাইরাস প্রোগ্রাম ছাড়াও ‘অ্যান্টি ম্যালওয়ার প্রোগ্রাম’ কম্পিউটারে ইন্সটল করুন। জোরদার বা জটিল কোনও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন, আর মাঝেমাঝেই সেটাকে বদলান।
সবচেয়ে বড় কথা হল, ই মেল-এ আসা কোনও অজানা লিঙ্ক বা ছবিতে ক্লিক করবেন না। সন্দেহজনক এসএমএস’কে পাত্তা দেবেন না। “আপনার কার্ড কোনও সোয়াইপিং ডিভাইসে একবার টানলেই কার্ডের সব তথ্য চলে যেতে পারে ওই যন্ত্রে। তার পর সেই তথ্য দিয়ে দিব্যি আসল কার্ডের নকল তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। আর মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে হ্যাক্ড হওয়ার প্রধান কারণ, না বুঝে ফোনে অ্যাপ্স ইন্সটল করা,” জানালেন আবির আতর্থী। আবিরের পরিচয় হল, ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিং’য়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আবার একজন ‘এথিক্যাল’ হ্যাকারও (যারা তথ্য চুরি করার জন্য নয়, অনলাইন নিরাপত্তার খুঁত ধরিয়ে দিতেই হ্যাক করেন)। যেমন আবির নাসা, অ্যাপল, হাভার্ড ইউনিভার্সিটি, ফেসবুক আর ফোর্বস ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইটের নানা রকম খুঁত ধরিয়ে দিয়েছেন।
ভরপুর ই-কমার্সের এই বিপুল নেটওয়ার্কে একটুও খুঁত থাকেবে না, এ হয় না কি! তাই সাধু সাবধান। মুহূর্তের বেখেয়ালে কিন্তু হ্যাকিং হানায় জীবনের চেনা ছক পালটে যেতে পারে সবারই।
|
মডেল: সৌমিলি ঘোষ বিশ্বাস
ছবি: কৌশিক সরকার |