|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
ছাত্র ইউনিয়ন প্রক্ষালন |
পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি সাধু উদ্যোগ লইয়া রাজ্যের মঙ্গল করিতে চলিয়াছে। কলেজগুলিতে ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন আগামী ছয় মাসের জন্য বন্ধ হইতেছে। সরকারের তরফে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন বিল রাজ্যের সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতির একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া তৈরি করিতে চলিয়াছে, যে প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতের ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনও সংঘটিত হইবে। গার্ডেনরিচ ঘটনার অভিঘাতেই এই টনক নড়া, দ্রুত পদক্ষেপ করিবার বাধ্যবাধকতা। বাস্তবিক, গত কয়েক দশক ধরিয়া কলেজ রাজনীতির নামে যে তীব্র হিংসার আস্ফালন এই রাজ্য দেখিয়াছে, তাহাতে অনেক আগেই এমন বন্দোবস্তের প্রয়োজন ছিল। জাতীয় স্তরের লিংডো কমিশনের যে সকল প্রস্তাব, তাহা রাজ্যের সর্বত্র কার্যকর করা উচিত ছিল। অনেক বিলম্ব হইল। তবু স্বাগত।
ছাত্র রাজনীতির এই সাম্প্রতিক অসুস্থতা উদ্বেগজনক হইতে পারে, কিন্তু সর্বৈব অপ্রত্যাশিত নহে। গত দেড় বৎসরে কলেজ ক্যাম্পাসের রাজনীতির ভয়াবহতা বিশেষ ভাবে দৃশ্যগোচর হইয়াছে ঠিকই, তবে এই মারাত্মক ব্যাধির প্রসার ও বাড়বাড়ন্তের জন্য মূলত দায়ী গত তিন দশকের বামফ্রন্ট সরকার। কলেজ ক্যাম্পাসের ছাত্র-সংগঠনের সহিত বৃহত্তর দলীয় সংগঠনকে একাত্ম করিয়া ফেলা এবং বহিঃশক্তি কাজে লাগাইয়া ছাত্র ইউনিয়নের দখল লইবার খেলায় বাম দলগুলি, বিশেষত সি পি আই এম যে উৎকর্ষ অর্জন করিয়াছিল, তাহার তুলনা তাহারা নিজেরাই! এত দিনে বিরুদ্ধ শক্তিও যথেষ্ট বলবান হইয়াছে, বাম রাজনীতির আকার ও প্রকার উত্তম রূপে শিখিয়া পড়িয়া লইয়াছে, উহারা ইট ছুড়িয়া মারিবার আগেই ইহারা সবেগে গুলি এবং বোমা চালাইতে সক্ষম হইতেছে। সুতরাং ছাত্র রাজনীতির নামে প্রবল হিংসায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইতেছে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলি। এ-হেন সঙ্গিন মুহূর্তে, বাঘের পিঠে সওয়ার হইয়াও ঠিক সময়ে বিপদ বুঝিয়া ব্যাঘ্রপৃষ্ঠ হইতে নামিয়া পড়িবার চেষ্টা করিয়া মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী উভয়েই রাজ্যবাসীর ধন্যবাদার্হ হইলেন।
অবস্থা আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া গেলে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ লইতেই হয়। তবে এই বন্দোবস্ত কেবলই সংকটকালীন বন্দোবস্ত নহে, দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের সূচনা হিসাবে দেখা দরকার। কিছু কালের জন্য ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনমূলক কাজকর্ম বন্ধ রাখা একটি ধাপ মাত্র: প্রকৃত লক্ষ্য, ছাত্র ইউনিয়নের চেহারাটিরই পরিবর্তন আনা। লিংডো কমিশন প্রস্তাব দিয়াছিল, অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে কলেজে উপস্থিতির রেকর্ড, পাশ-ফেল রেকর্ড, ইউনিয়নের কাজে বাহিরের লোককে কোনও ভাবেই প্রবেশাধিকার না দেওয়া ইত্যাদি নীতি মানিয়া চলিতে। অপরাধমূলক কাজকর্মের ইতিহাস আছে, এমন কোনও ব্যক্তিকে প্রার্থী বা নেতা হিসাবে নির্ধারণ না করিবার নির্দেশ ছিল। এই সব প্রস্তাব মানিয়া চলিলেই কিন্তু দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হইবার কথা, যেখানে অত্যন্ত সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি সত্ত্বেও গুন্ডামি বা দলীয় পেশিশক্তির কোনও স্থান নাই, বরং পুরাদস্তুর সুস্থ রাজনৈতিক মতবিনিময়ের পরিবেশ রহিয়াছে। এইটুকু অর্জন করিতে পারিলেই এ রাজ্যের পক্ষে তাহা বিরাট সুসংবাদ। কিন্তু, প্রসঙ্গত, পুনর্বিচার যখন হইতেছেই, আরও খানিকটা অগ্রসর হইলে দোষ কী? গোটা কলেজের প্রতিনিধিত্ব করাই যদি কলেজ ইউনিয়নের প্রাথমিক দায়িত্ব হয়, বিভিন্ন বিভাগকেই তো দায়িত্ব বাঁটিয়া দেওয়া যায় যাহাতে তাহারা নিজ নিজ বিভাগ হইতে নির্ধারিত সংখ্যক শ্রেণি-প্রতিনিধি মনোনয়ন করিয়া কলেজ ইউনিয়নে প্রার্থী হিসাবে পাঠাইয়া দেন। এ ভাবে আরও খানিকটা বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়, বহিরাগত দলীয় রাজনীতির সম্ভাবনা কমে, কলেজের নিজস্ব অন্তর্জীবনের প্রতিফলন সম্ভব হয়, ছাত্রদের অভাব-অভিযোগ-মতামতের প্রতিনিধিত্ব আরও স্পষ্ট হয়। ছাত্রদের ইউনিয়ন গঠনের অধিকার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করিয়াই কি সেই অধিকার কার্যকর করা উচিত নহে? বাহিরের চাপের কাছে নতি স্বীকারের অর্থ তো নিজের/নিজেদের স্বাধীন, স্বতন্ত্র মতামতের অধিকার বিসর্জন দেওয়া! |
|
|
|
|
|