|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
শিল্পীর মুখের বিপরীতেই এক কল্পমায়ার জগত্ |
সম্প্রতি হ্যারিংটন স্ট্রিট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল রঘু রাই-এর একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
উস্তাদ বিসমিল্লা খানের মুখটি যেন অনন্ত নৈঃশব্দ্যের ভিতর ভাসছে। নৈঃশব্দ্য অন্ধকারে জমাট বেঁধে আছে। সুরের ভিতরের স্তব্ধতা। শব্দ আর নৈঃশব্দ্যের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠে সুর। সুরের প্রবাহই সঙ্গীত। শিল্পীর চোখ দু’টি বোজা। নীচে অবতলের প্রান্ত জুড়ে অন্ধকার। বিস্তৃত কপালের উপর আলো। সমান্তরাল কয়েকটি বলিরেখা কপালের মধ্যভাগে। তীক্ষ্ণ নাসিকাটি আলোয় উজ্জ্বল। তার নীচেই ঠোঁটের দু’পাশ পরিব্যাপ্ত করে খেলে যাচ্ছে সংবৃত ছায়া। ঠোঁটের অবস্থান ও আলোছায়ার দ্বৈত মুখমণ্ডলে হাল্কা হাসির আভা ছড়িয়ে রাখে। অদ্ভুত তন্ময়তা এই হাসির ভিতর। এই তন্ময়তাও এক নৈঃশব্দ্য তৈরি করছে, যা পরমুহূর্তেই সুরে ঝংকৃত হয়ে উঠবে। সানাইটিও অন্ধকারের ভিতর জেগে আছে একটু দূরে মুখের সঙ্গে কৌণিক অবস্থানে। সমগ্র শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন। শুধু শেষ প্রান্তে তিনটি আঙুল ছুঁয়ে আছে তাকে। পিছনে নিবিড় অন্ধকার সমগ্র চিত্রপট জুড়ে। সেই অন্ধকারের ভিতর একটি নৃত্যরত ছায়ামূর্তি হয়তো দাঁড়িয়ে আছে। আলোকরেখা দিয়ে গড়া। হয়তো সে কোনও মূর্তি নয়। শুধুই সামান্য আলোর বিন্যাস। অথচ শিল্পীর মুখের বিপরীতে তার অবস্থান এক কল্পমায়ার সৃষ্টি করে। বিসমিল্লা খানের সঙ্গীতের লৌকিক ধ্বনিপুঞ্জের নৈঃশব্দ্যকে যেন ধরতে চাওয়া হয়েছে ছবিটিতে।
এই আলোকচিত্রের শিল্পী রঘু রাই। দ্য হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট সেন্টারে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর একটি আলোকচিত্রের প্রদর্শনী। ৪৮টি সীমিত সংস্করণের ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ইন্ডিয়াজ গ্রেট মাস্টার্স’। ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পীদের ছবি। শিল্পীর মুখকে ক্যামেরায় ধরতে গিয়ে আলোকচিত্রী অনেক সময়ই ধরে ফেলেছেন সুরের তন্ময়তাকে। যেমন আমরা দেখলাম বিসমিল্লা খানের ছবিটিতে। মূর্ততা দিয়ে বিমূর্ততাকে অসামান্য নিদর্শন রঘু রাই-এর এই ছবিগুলি। নৈঃশব্দ্যের ভিতর প্রাণ সঞ্চার করা সঙ্গীতের একটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। সঙ্গীত যেমন সুর সৃষ্টি করে তেমনই স্তব্ধতাও সৃষ্টি করে। সমান্তরাল ভাবে আলোকচিত্রও আলোর বিপরীতে রচনা করে তমসা। এই প্রক্রিয়ায় বাস্তবকে রূপান্তরিত করে কল্পরূপে। এই ক্ষেত্রে আলো আর অন্ধকার এই দু’টি মাত্র মাত্রা নিয়ে কাজ করলে আলোকচিত্র কত শিল্পঋদ্ধ হয়ে উঠতে পারে রঘু রাই-এর ছবিগুলি তার অসামান্য দৃষ্টান্ত।
|
|
শিল্পী: রঘু রাই |
বিসমিল্লা খানের আরও কয়েকটি ছবি ছিল এই প্রদর্শনীতে। একটি ছবিতে শিল্পী বসে আছেন চৌকির উপরে। সাদা পাজামা-কুর্তায় সুসজ্জিত। মাথায় টুপি। পাদুকা দু’টি চৌকির পাশে মেঝের উপর রাখা। খুবই সাধারণ একটি অবয়বচিত্র। কিন্তু ছবিটিতে নান্দনিক সুষমা ফুটে ওঠে আলো-ছায়ার বিন্যাসের মধ্য দিয়ে। আগের ছবিটির মতো এখানে আলো-আঁধারের বিপ্রতীপতা নেই তেমন। রয়েছে আলোর সঙ্গে ছায়ার স্নিগ্ধ এক মেলবন্ধন। সেই মেলবন্ধনের ভিতর দিয়ে প্রশান্তি তৈরি হয়েছে। আর একটি ছবিতে শিল্পীকে দেখি একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে। ঘরের ভিতর মেঝের উপর একটি আসনে বসে নাতিকে আদর করছেন শিল্পী। ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে তাঁর কোল ঘেঁষে। পিছনে থামের পাশে দু’একজন মানুষের চলাচল। এ ছবিতে আলোরই প্রাধান্য। অন্ধকার আছে শুধু থামের ও পাশে। তা এ পাশের আলোকে খুব যে প্রভাবিত করছে তা নয়। বারাণসীর দরগায় বিসমিল্লা খানের ছবিটিতে অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে শিল্পীকে।
পণ্ডিত ভীমসেন যোশী গাইছেন। সুরের মূর্ছনা বিস্তারের একটি মুহূর্তকে ধরেছে ছবিটি। উপরে নীচে তীব্র অন্ধকার। মধ্যভাগে শিল্পী। দু’পাশে দু’টি তানপুরা। সুরের তন্ময়তায় আচ্ছন্ন শিল্পী। ডান হাতটি নিবেদনের ভঙ্গিতে ছড়িয়ে রাখা। বিসমিল্লার ছবিটিতে দেখেছি আমরা সুরের মধ্যবর্তী স্তব্ধতা। আর এই ছবিটিতে সুরের বিস্তারের উদাত্ততা। মগ্ন হয়ে সরোদ বাজাচ্ছেন আলি আকবর খান। তবলায় বোল তুলছেন উস্তাদ আল্লারাখা। কিশোরী আমনকর ঘরের ভিতর সোফায় বসে রেওয়াজ করছেন। হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া বাঁশি বাজাচ্ছেন সমুদ্রতীরে বসে। বিলায়েত খান একটি তানের অন্তে সমে পৌঁছে হাত তুলে দিয়েছেন। এ রকম উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নানা শিল্পীর সাঙ্গীতিক মুহূর্ত ধরা হয়েছে ছবিগুলিতে।
রঘু রাই-এর কলকাতার ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছিল এই গ্যালারিতেই কিছু দিন আগে। এ বার আমরা দেখলাম সঙ্গীতের আলোকচিত্র। আলো দিয়ে গড়া এই শিল্পমাধ্যমে তমসাকে বা নৈঃশব্দ্যকে কী ভাবে তৈরি করতে হয়, তারই অনবদ্য নিদর্শন এই প্রদর্শনীর ছবিগুলি। |
|