মাদ্রাসা পরীক্ষা চলায় খোলা মাঠে সভা করা যায়নি। বর্ধমান শহরের সংস্কৃতি লোকমঞ্চে নিহত দুই সিপিএম নেতা প্রদীপ তা ও কমল গায়েনের স্মরণসভায় উপচে পড়ল কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। অসুস্থতার কারণে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আসতে না পারলেও অনেকেই প্রেক্ষাগৃহের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। তাঁদের জন্য বাইরে টিভিতে অনুষ্ঠান সম্প্রচারও করা হয়।
গত বছর এই ২২ ফেব্রুয়ারিই দেওয়ানদিঘিতে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপবাবু এবং সত্তরোর্ধ্ব নেতা কমলবাবুকে। অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অর্ধেকই এখনও অধরা। এই হত্যার ঘটনাকে সামনে রেখেই শাসকদলের বিরুদ্ধে একটানা সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে আসছে বর্ধমান জেলা সিপিএম। সে দিক থেকে বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মঞ্চে ছিলেন প্রদীপবাবুর স্ত্রী চিত্রলেখা ও মেয়ে পৃথা। পাশেই বসে ছিলেন কমলবাবুর স্ত্রী কাকলী গায়েনও। প্রেক্ষাগৃহের একপাশে দুই নেতার ফুলে ঢাকা ছবি। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু ও প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের পাশাপাশি হাজির ছিলেন জেলা বামফ্রন্টের সমস্ত নেতাই। |
সভার শুরুতেই সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদার বলেন, ‘‘প্রদীপ তা বা কমল গায়েনকে হারানোর ব্যথা বুকে নিয়েই আমাদের নানা কর্মসুচি পালন করতে হবে। প্রতি দিন জেলার বাম কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন।” তা সত্ত্বেও তিনি দাবি করেন, “সরকার ক্রমেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ওদের জমায়েত করার ক্ষমতা কমছে। আমাদের বাড়ছে। ফলে আমাদের আর জমায়েত করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিটি সমাবেশে বাধা আসছে। কোথাও আমরা সভা-সমিতি বা মিছিল করতে পারছি না। নানা অজুহাতে আটকে দেওয়া হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। আর ওরা পরীক্ষার সময়েও মাইকে বাজিয়ে সভা করছে। শুধু দুই নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা বা শোক প্রকাশ করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয় না।”
এর পরে বলতে উঠে তীব্র ভাষায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আক্রমণ করেন নিরুপমবাবু। বলেন, “প্রদীপ তা ও কমল গায়েন খুনের পরেই দেখা গিয়েছে, তৃণমূল কতটা নির্লজ্জ ভাবে পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করতে পারে। মাত্র এক বছর আগে তৃণমূলের হাতে সিপিএমের নেতারা খুন হচ্ছিলেন। এখন ওদেরই হাতে প্রকাশ্যে পুলিশ খুন হচ্ছে। আমাদের নেতাদের পাথর দিয়ে থেঁতলে খুন করা হয়েছিল। এখন তৃণমূলের লোকেদের উন্নতি হয়েছে। এই বছর ফেব্রুয়ারিতে পুলিশকর্মীকে খুনে ব্যবহার করা হয়েছে পিস্তলের গুলি। এটা উন্নতি ছাড়া কী?”
দলের নিচুতলার কর্মীরা প্রায় এক বছর পরে শহরের প্রাক্তন ও পরাজিত বিধায়ক নিরুপমবাবুকে সামনে দেখলেন। এক বছর আগে দুই নেতার স্মরণসভায় তিনি বক্তৃতা করে গিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বন্ধ-বিরোধিতা প্রসঙ্গে নাম না করেও তিনি বলেন, “মাত্র ১৩ বছরের দল ১৩ বার বন্ধ ডেকেছেন। দিনের পর দিন অবরোধ করেছেন। কাজকর্ম অচল করে দিয়েছেন। এখন বলছেন কর্মনাশা বন্ধ?” প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রীর দাবি, “আমরা চলে যাওয়ার সময়ে, ২০১১ সালে মোট ঋণের পরিমান ছিল ১ লক্ষ ৯২ কোটি টাকা। নতুন সরকার এক বছরেই সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ করেছে। কিছু দিনের মধ্যেই পরিমানটা ২২ হাজার কোটিতে দাঁড়াবে। নতুন সরকারের বাজেটে বলা হয়েছে, হাতে থাকছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। কর্মচারিদের বেতন, আগের ঋণের সুদ ইত্যাদি দিতে তার শতকরা ৬৭ ভাগ খরচ হয়। বাকি ৩৩ ভাগ তো হাতে থাকে। তা দিয়ে সহজেই উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। কিন্তু নীতিহীন, যুক্তিহীন, আদর্শহীন দলের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না।”
আগাগোড়া আক্রমণাত্মক ছিলেন বিমানবাবুও। তাঁর হিসেবে, “নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পর থেকে কমল গায়েন-প্রদীপ তায়ের মতো আমাদের ৮৫ জন কর্মী খুন হয়েছেন। তাঁদের কেউ কিন্তু অসামাজিক জীব নন। গুন্ডা-বদমায়েশ নন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়েই খুন হয়েছেন।” তাঁর সংযোজন, “এখন তৃণমূলের হাতেই তৃণমূলের কর্মীরা খুন হচ্ছেন। আগে যেমন কংগ্রেসের হাতে খুন হতেন কংগ্রেসের লোকেরা। রাজ্য জুড়ে আইনশৃঙ্খলা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।” গত ২২ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দুই নেতাকে খুনে অভিযুক্ত ছিলেন মোট ২২ জন। তিন জনকে ছেড়ে দিয়ে ১৯ জনের নামে চার্জশিট দেওয়া হয়। এর ভিতরে আবার ১১ জনকে পুলিশ বা সিআইডি গ্রেফতার করেছে। বাকিরা আপনাদের এই বর্ধমানেই কোথাও না কোথাও গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। ঠিক যেমন গার্ডেনরিচের সেই ‘চেয়ারম্যান সাব’ কলকাতাতেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। প্রশাসন এতটাই নির্লজ্জ হয়েছে যে, তাঁদের খোঁজ পাচ্ছে না। তবে এক মন্ত্রী যদি তাঁকে আড়াল করার চেষ্টা করেন, তা হলে আর কী হবে?” তিনি জানান, প্রদীপ-কমল হত্যাকান্ডে অধরাদের ধরার দাবিতে ফের হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবে দল। এ বার রাজ্যের পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির আসন বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫৮ হাজার। বিমানবাবু বলেন, “আশা করছি, আমরা সব আসনেই প্রার্থী দেব।” |