|
|
|
|
১৪ মিনিটে ৩ বার কাঁপল দিলসুখনগর, নিহত ১৩ |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
স্তূপীকৃত দেহ। কারও হাত, কারও পা, কারও বা অন্য কোনও দেহাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে হায়দরাবাদের জনবহুল শহরতলি দিলসুখনগরের রাস্তায়। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে টাটকা রক্তের দাগ। মাত্র ১৪ মিনিটে তিন তিনটি বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে পুরো এলাকাটি। প্রাণ গিয়েছে অন্তত ১৩ জনের। আহতের সংখ্যা সত্তরেরও বেশি। তাঁদের মধ্যে পাঁচ-ছ’জনের অবস্থা গুরুতর। ফলে নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা করছে প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ ভাবেই সন্ত্রাস ফিরে এল নিজামের শহরে। এবং এই নিয়ে সতর্কবার্তা থাকা সত্ত্বেও। অন্তত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের তাই দাবি। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শিন্দে বলেন, “দু’দিন আগেই আমাদের কাছে হামলার খবর ছিল। আমরা রাজ্যগুলিকে সতর্কও করেছিলাম।” কিন্তু ঠিক কী ধরনের তথ্য ছিল তাঁদের কাছে, সে প্রশ্ন তোলা হলে কার্যত এড়িয়ে যান শিন্দে। উল্টো দিকে, অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের কাছ থেকে জানা যায়নি, তারা কী ধরনের সতর্কবার্তা পেয়েছিল।
তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি রুটিনমাফিক সতর্কবার্তা? সেটা সামনে রেখে কি শিন্দে ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন? যেমনটা এর আগে পুণে-সহ একাধিক বিস্ফোরণের পরে করতে চেয়েছিল কেন্দ্র?
বস্তুত, দু’মাসের ব্যবধানে আজমল কসাব এবং আফজল গুরুর ফাঁসির পরে দেশ জুড়ে সতর্কতা ছিলই। সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিও ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। আর প্রশাসনের একাংশই বলছে, হায়দরাবাদ জঙ্গিদের প্রিয় নিশানাগুলির অন্যতম। এর আগে ২০০২ সালে এই দিলসুখনগর এলাকার সাইবাবা মন্দিরের কাছেই বিস্ফোরণ হয়েছিল। এ দিনও সেই জায়গাটি সন্ত্রাসের নিশানা হয়েছে। ২০০৭ সালেও দু’বার নিশানা হয় হায়দরাবাদ। |
|
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মৃতদেহ। বিস্ফোরণের পর হায়দরাবাদের কাছে দিলসুখনগরে। ছবি: এপি |
আজকের ঘটনাতেও ২০০৭ সালের ২৫ অগস্টের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন অনেকে, যে দিন লুম্বিনী পার্কের সঙ্গে দিলসুখনগরের কাছাকাছি গোকুল চাট ভাণ্ডারেও বিস্ফোরণ হয়।
ঠিক কী হয়েছিল এ দিন?
হায়দরাবাদ পুলিশ সূত্রে খবর, প্রথম বিস্ফোরণটি হয় ৭টা বেজে ১ মিনিটে, কোণার্ক সিনেমা হলের সামনে। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। স্থান বেঙ্কটাদ্রি সিনেমার লাগোয়া ফুটব্রিজ। পুলিশের দাবি, দুই ঘটনাস্থলের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ৫০০ মিটার। এর খুব কাছেই রয়েছে সাইবাবা মন্দির। তৃতীয় বিস্ফোরণটি হয় ৭টা ১৫ মিনিটে। ঘটনাস্থল, বিজয়ওয়াড়া-হায়দরাবাদ জাতীয় সড়কের একটি বাস টার্মিনাস।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, পরপর বিস্ফোরণের প্রাথমিক অভিঘাতে দিশাহারা হয়ে পড়েন এলাকার মানুষ। চার দিকে জখমদের আর্তনাদ। ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি। আবার কখন কোথায় বিস্ফোরণ হয়, সেই আশঙ্কায় যে যে দিকে পারছেন, ছুটছেন। কিন্তু কোন জায়গাটা নিরাপদ, বুঝতে পারছেন না। ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন এক ব্যক্তি বললেন, “এত ভিড় যে যানজট হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যেই দেখি, ৪-৫টা অ্যাম্বুল্যান্স ছুটে আসছে। এক জনকে জিগ্গেস করলাম, কী হয়েছে? ছুটতে ছুটতেই বলল, বোমা ফেটেছে। পালাও!”
তত ক্ষণে এলাকা ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। তল্লাশিতে নিকটবর্তী কয়েকটি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাজা বিস্ফোরকও। দিলসুখনগরে তদন্তের কাজে পৌঁছে যায় ফরেন্সিক দল। পৌঁছেছেন জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ-র গোয়েন্দারাও। পরিদর্শনে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী কিরণকুমার রেড্ডি। যাচ্ছেন শিন্দেও। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “অপরাধীরা শাস্তির হাত থেকে
বাঁচতে পারবে না।” পরে রেড্ডিও জানান, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। |
বিস্তারিত দেখতে... |
|
প্রশ্ন যেখানে |
• দু’দিন আগেই খবর আসে। দাবি খোদ শিন্দের।
তবু কী ভাবে বিস্ফোরণ? |
• তথ্য বিনিময় নিয়ে কি কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের অভাব? |
• পিছনে কি ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন? |
|
নিহতদের পরিবারকে ৬ লাখ টাকা করে ও আহতদের ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি। কেন্দ্রও নিহতের পরিবারকে দু’লক্ষ ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দেবে। সম্প্রতি হিন্দু সন্ত্রাস নিয়ে তুমুল বিতর্কের পরে এ দিন শিন্দে এমন কিছু বলেননি, যাতে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। দু’বার সাংবাদিকদের সামনে এসেছেন। কিন্তু প্রতিবারই এই বিষয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে যে ভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, তাতে অনেকেই ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের হাত দেখতে পাচ্ছেন। এই দলের বক্তব্য, সাইকেলের ক্যারিয়ারে টিফিন বাক্সে বিস্ফোরক রেখে আসা হয়েছিল।
দিল্লি-হায়দরাবাদ-বারাণসী এ ভাবে নাশকতা ঘটানোর ইতিহাস রয়েছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের (আইএম)।
আইএমের উপরে সন্দেহ জোরদার হয়েছে আরও একটি কারণে। কিছু দিন আগেই ফাঁসি হয়েছে আফজল গুরুর। তার প্রতিশোধ নিতে আইএম যে এ হেন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, সে কথাও মনে করছেন প্রশাসনের একাংশ।
পাশাপাশি একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে। দিল্লি পুলিশের একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, মাস ছয়েক আগে আইএমের হয়ে চার সন্ত্রাসবাদী দিলসুখনগর রেকি করে যায়। আইএমের রিয়াজ ভাটকল গোষ্ঠী তাদের এই কাজে পাঠিয়েছিল বলে পুলিশের কাছে কবুল করেছে তারা। ওই সময়েই পুণেতে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ হয়। সেখানেও আইএম রেকি করেছিল। তবে কম ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল বলে (যা আইএমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য) পুণের ধারাবাহিক বিস্ফোরণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। |
|
হাসপাতালে ভিড় শোকার্ত আত্মীয়দের। বৃহস্পতিবার। ছবি: এ এফ পি |
তথ্য আদানপ্রদান নিয়ে গোয়েন্দা-সূত্রেও দাবি করা হয়েছে, ৯ ফেব্রুয়ারি আফজল গুরুর ফাঁসির পর থেকেই অন্তত তিনটি সতর্কবার্তা দিয়েছিল তারা। যার মধ্যে শেষ দু’টি এসেছে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই। তাঁদের আরও দাবি, গত এক সপ্তাহ ধরেই বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের গতিবিধির উপর নজর রাখছিলেন তাঁরা। কয়েকটি ফোনে আড়ি পাতাও হয়। সেখান থেকেই মিলেছিল বোমা-বিস্ফোরণের ইঙ্গিত। সে তথ্য জানানোও হয়েছিল রাজ্য সরকারগুলিকে। কিন্তু তাতেও থামানো গেল না নাশকতা।
গোয়েন্দা কর্তার দাবি, ‘টাইমার ডিভাইস’ ব্যবহার করা এই আইইডি বিস্ফোরণে স্থানীয় সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য নিয়েছে এক ‘বিশেষ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’। এ প্রসঙ্গে নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন সিমির কথাও উঠেছে। গোয়েন্দা-বিভাগের বক্তব্য, সিমি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার সদস্যরাই আইএমের হয়ে কাজ করে। তাই সন্দেহের তির আইএমের দিকে। যদিও আকবারউদ্দিন ওয়াইসির গ্রেফতারির ঘটনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দা-কর্তারা। ওয়াইসি অবশ্য এ দিন সকলকে শান্ত থাকতে অনুরোধ করেন। বলেন, “এই ঘটনা আমার দেশবাসীর উপরে আক্রমণ।”
দিল্লি পুলিশের রিপোর্ট ও গোয়েন্দাদের দাবি মেনে নিলে প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি এই তথ্য কেন্দ্র জানায়নি অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারকে? দুই জায়গাতেই শাসক দল কংগ্রেস। সুতরাং সমন্বয়ের অভাব হওয়া উচিত নয়। তবু আক্রান্ত হল দিলসুখনগর। এবং বেঘোরে প্রাণ গেল এতগুলো লোকের। এই ঘটনার পরে এলাকার বাসিন্দারাও দোষ দিচ্ছেন রাজনীতিকদের। তাঁরা বলছেন, কে কী তথ্য দিয়েছে, কাকে দিয়েছে এ সব জেনে কী হবে!
|
আরও তেরো |
কবে |
কোথায় |
হত |
৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১ |
হাইকোর্ট চত্বর, দিল্লি |
১২ |
১৩ জুলাই, ২০১১ |
দাদার-অপেরা হাউজ, জাভেরি বাজার, মুম্বই |
২৬ |
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ |
জার্মান বেকারি, পুণে |
১৭ |
২৬ নভেম্বর, ২০০৮ |
তিন দিন ধরে হানা, মুম্বই |
১৬৬ |
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ |
ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, দিল্লি |
২৬ |
২৬ জুলাই, ২০০৮ |
ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, আমদাবাদ |
৫৭ |
২৫ জুলাই, ২০০৮ |
আইআইএসসি, বেঙ্গালুরু |
১ |
১৩ মে, ২০০৮ |
ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, জয়পুর |
৮০ |
২৫ অগস্ট, ২০০৭ |
লুম্বিনী পার্ক, হায়দরাবাদ |
৩০ |
১৮ মে, ২০০৭ |
মক্কা মসজিদ, হায়দরাবাদ |
১১ |
৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৬ |
মালেগাঁওহত |
৩০ |
১১ জুলাই, ২০০৬ |
লোকাল ট্রেন, মুম্বই |
২০০-রও বেশি |
|
|
|
|
|
|