বরো চেয়ারম্যানের প্রতিপত্তির পিছনে মন্ত্রী ছিলেন আসল খুঁটি। সে খুঁটি এখন নড়বড়ে। ঘরে-বাইরে চাপে পড়ে পুলিশ-খুনের মামলায় অভিযুক্ত ইকবালের মাথার উপর থেকে আশ্রয়ের ছাতা সরিয়ে নিতে চাইছেন পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এমনকী, একদা স্নেহধন্যের বাড়ির লোকের ফোনও এখন মন্ত্রী ধরতে চাইছেন না বলে খবর! অন্য দিকে, ইকবালকে গ্রেফতারের তত্পরতা চলছে জোর কদমে।
সেই সূত্রেই ফেরার পুর-কর্তা মহম্মদ ইকবালের বাড়িতে বুধবার রাতে দরজা ভেঙে তল্লাশি চালাল পুলিশ। যা নিয়েও মন্ত্রী মাথা ঘামাতে নারাজ। একই সঙ্গে এলাকায় বরো চেয়ারম্যানের মদতপ্রাপ্ত অবৈধ নির্মাণগুলি বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে পুলিশ-সূত্রের খবর।
গার্ডেনরিচের হাঙ্গামায় এসআই তাপস চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশের খাতায় যাঁর নাম উঠে গিয়েছে, ১৫ নম্বর বরোর সেই তৃণমূল চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম তাঁকে রক্ষা করবেন। ববিও এত দিন নির্দ্বিধায় বিশ্বাসভাজনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গার্ডেনরিচের ঘটনার পরেও তিনি খাস মহাকরণে জোর গলায় জানাতে কসুর করেননি যে, মুন্না নির্দোষ।
কিন্তু বৃহস্পতিবার মুন্নার মেয়ে সাবা বলেন, “ববি আঙ্কল আমাদের ফোন তুলছেন না।” সাবা এ-ও জানিয়েছেন, বুধবার রাতে সিআইডি-র দল গার্ডেনরিচের আয়রন গেট রোডে তাঁদের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ঢুকে তল্লাশি চালিয়েছে। তাঁর অভিযোগ, “পুলিশ আমাদেরও হেনস্থা করেছে। এমন আগে কখনও হয়নি।”
সিআইডির ডিআইজি (স্পেশ্যাল) বিনীত গোয়েল অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “ঘরে লাইট জ্বলছিল। বার বার দরজা খুলতে বলা হয়। সাড়া না-পেয়ে অন্য কয়েক জন ভাড়াটের সামনে দরজা ভাঙা হয়েছে। তবে ইকবালকে পাওয়া যায়নি।” বন্দরের তৃণমূল-সূত্রে খবর: পুরমন্ত্রী বৃহস্পতিবার এ দিন ৭৬ নম্বর ওয়ার্ডে গোপাল ডাক্তার রোডের বিধায়ক অফিসে এলে মুন্নার বাড়িতে সিআইডি-র ‘তাণ্ডবের’ কথা তাঁর কানে তোলা হয়েছিল। মন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছু করতে পারবেন না।
বস্তুত, খুনের মামলায় নাম জড়ানো বরো চেয়ারম্যানের পাশে বরাবর থাকাটা মন্ত্রীর পক্ষে যে কঠিন হবে, দলীয় মহলে তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। মহাকরণ সূত্রের খবর: তিন কেন্দ্রে উপনির্বাচনের মুখে মন্ত্রী-অভিযুক্ত সংস্রব দলকে ভোগাতে পারে, এমন আশঙ্কায় ববিকে পুরো বিষয়টি থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে জড়িত কাউকে যে রেয়াত করা হবে না, মানুষকে সে বার্তা দিতে থাকেন দলের বিভিন্ন শীর্ষ নেতা। রেজিনগরের জনসভায় শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় আশ্বাস দেন, ‘সব অপরাধীকে গ্রেফতার করা হবে।’ এ দিনও পার্থবাবুর ঘোষণা, “অপরাধীদের গ্রেফতার করার কথা প্রশাসনকে আমি শ্মশানে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম। নিহতের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েও বলেছি। এখনও বলছি।” ঘটনাটি প্রসঙ্গে রাজ্যপালের মন্তব্যও পুরমন্ত্রীর পক্ষে স্বস্তিদায়ক হয়নি।
দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যা: এ হেন বহুমুখী চাপের মুখে ইকবাল-সঙ্গ ত্যাগ করা ছাড়া পুরমন্ত্রীর সামনে অন্য পথ খোলা ছিল না। রবিবার মুরারইয়ে ববি নিজে বলেছেন, কোন কাউন্সিলর কোথায় কী করছেন, তা তাঁর পক্ষে জানা অসম্ভব। এবং স্থানীয় তৃণমূল-সূত্রের খবর: সোমবার সকালে নলহাটিতে উপনির্বাচনের প্রচারে যাওয়ার আগে ববি যখন বিধায়ক অফিসে, তখন তাঁর মোবাইলে একটি ফোন এসেছিল। অত্যন্ত শীর্ষ স্তর থেকে আসা সেই ফোনে ববিকে বলা হয়, মুন্না যেন অবিলম্বে পুলিশের কাছে ধরা দেন। ববির ঘনিষ্ঠ মহল ওই ফোনের কথা অস্বীকার করলেও দলীয় সূত্রের দাবি, দল তথা প্রশাসনিক নেতৃত্ব যে তাঁর মুন্না-ঘনিষ্ঠতা ভাল চোখে নিচ্ছে না, মন্ত্রীর তা টের পেতে দেরি লাগেনি।
মুন্নাকে সাঁড়াশি চাপে ফেলতে মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচে বরো চেয়ারম্যানের মদতে গজিয়ে ওঠা বেআইনি নির্মাণগুলির কাজ অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে লালবাজার। কলকাতা পুলিশ-সূত্রের খবর: মুন্নার মদতে কোন কোন অবৈধ নির্মাণ চলছে, তার তালিকা আগেই তৈরি হয়েছিল। পুলিশের দাবি: গার্ডেনরিচের অপ্রশস্ত গলিতে যেখানে পুরসভার দোতলার বেশি নির্মাণের ছাড়পত্র দেওয়ার কথা নয়, সেখানে মুন্নার সৌজন্যে অবাধে তিন-চারতলার ছাড়পত্র মিলত। এ ভাবে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিচালিঘাট, গার্ডেনরিচ রোড, প্রিন্স দিলওয়ার ঝা লেন, আলিফনগর, মেহের মঞ্জিল, বাংলা বস্তি, বাতিকল, ধানখেতি, মেথরপাড়া, ফতেপুর ভিলেজ রোড, কসাইপাড়া, আতাবাগের মতো এলাকা গত দু’-আড়াই বছরে অগুনতি অবৈধ নির্মাণে ভরে গিয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে শুরুও করেছিল বলে সূত্রের দাবি। তা থমকে গেল কেন?
এ ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক প্রতিপত্তি’র অভিযোগ তুলছেন পুলিশ অফিসার-কর্মীদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, গত ৮ জানুয়ারি মুন্না তদন্তকারী অফিসারদের বরো অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়ে মন্ত্রীর উপস্থিতিতে হেনস্থা করেন, যার পরে পুলিশ কার্যত হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। লালবাজারের এক কর্তা আরও জানাচ্ছেন, গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের সপ্তাহ দুয়েক আগে তাঁরা ওই তল্লাটের প্রায় ৯০টি অবৈধ নির্মাণের তালিকা বানিয়ে কলকাতা পুরসভা কর্তৃপক্ষকে, বিশেষত ডিজি (বিল্ডিং)-কে পাঠিয়েছিলেন। পুর-আইন মোতাবেক, পুর-কর্তৃপক্ষ বেআইনি নির্মাণগুলোর বিরুদ্ধে নোটিস দিলে তবেই পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। “কিন্তু ওই সব কাগজই তো আবার বরো চেয়ারম্যানের টেবিলে গিয়ে পড়ত! তিনি সেগুলো ডাস্টবিনে ফেলতেন। আমাদের কিছু করার থাকত না।”— আক্ষেপ তাঁর।
তবে এ বার তালিকা ধরে ধরে নতুন উদ্যমে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বুধবার রাত পর্যন্ত গার্ডেনরিচে এ ধরনের পাঁচটি অবৈধ নির্মাণের কাজ বন্ধ করা হয়েছে বলে পুলিশ-সূত্রের খবর। |