পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের কি ডানা ছাঁটা হচ্ছে? শনিবার দিনভর এই জল্পনা চলল।
মন্ত্রিত্ব থেকে কাউকে সরানো হলে তার লিখিত প্রমাণ থাকে। সেটা হয়নি। বাকি থাকে দলীয় ও সরকারি মুখপাত্রের দায়িত্ব। যে ভার মৌখিক ভাবে ববিকে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে ক্ষেত্রে ববির ডানা ছাঁটা মানে তাঁকে মুখপাত্রের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া। ববি নিজে বা তাঁর দলের অন্য কোনও শীর্ষ নেতা এ দিন রাত পর্যন্ত এই ধরনের জল্পনায় আমল দেননি।
গার্ডেনরিচ কাণ্ডে অভিযুক্ত দলীয় নেতা ও স্থানীয় বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবালের পাশে দাঁড়ানোয় ববি কিছুটা কোণঠাসা হয়েছেন। ইকবালকে গ্রেফতার না করার জন্য পুলিশের উপর চাপ সৃষ্টির অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে আছে। অন্য দিকে, অভিযুক্তদের ‘সকলকে’ গ্রেফতার না করার অভিযোগ মাথায় নিয়েই কলকাতা পুলিশের কমিশনার পদ থেকে সরতে হয়েছে রঞ্জিত পচনন্দাকে। স্বয়ং রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন পুলিশ কমিশনারের অপসারণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। তাই ববির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের উপর চাপ বাড়ছে। |
রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় শুক্রবার রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করায় বিষয়টি আরও গুরুত্ব পায়। তৃণমূলের অন্দরের খবর, পার্থবাবুকে রাজ্যপাল স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, তিনি চাকরিজীবনে গোয়েন্দা বিভাগে (ইনটেলিজেন্স) কাজ করেছেন। তাই ইনটেলিজেন্স সূত্রে খবর সংগ্রহের পদ্ধতি তাঁর জানা আছে। সে ভাবেই তিনি জেনেছেন, গার্ডেনরিচে কী হয়েছিল এবং ববি-সহ অন্য তৃণমূল নেতাদের কার কী ভূমিকা। রাজ্যপালের মন্তব্য ছিল, “আমি মনে করি, এমন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করা উচিত।” রাজ্যপালের এই মতের বিরুদ্ধে পার্থবাবু অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিয়ে এসেছেন। এমনকী, ববির মতো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে বহরমপুরে অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, এমন যুক্তিও দিয়েছিলেন বলে খবর। কিন্তু রাজ্যপাল তাঁর মত থেকে সরেননি।
শুক্রবার রাতেই রাজ্যপালের এই মনোভাব মুখ্যমন্ত্রীর কানে পৌঁছয়। ববি সম্পর্কে বিভিন্ন ‘বিরূপ মতামত’ যে ছড়াচ্ছে, সে সম্পর্কেও তাঁকে অবহিত করার চেষ্টা হয়। মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি ‘দেখে নেবেন’ বলে জানান। এর আগে তিনি নিজেই বৃহস্পতিবার ববিকে সরকারের ‘মুখ পোড়ানো’র জন্য তিরস্কার করেছিলেন। ফলে ববির ডানা ছাঁটা নিয়ে জল্পনা আরও বাড়ে। এ দিন রেজিনগরে উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও দাবি করেন, মন্ত্রিসভা থেকে ফিরহাদকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “গার্ডেনরিচের ঘটনাটিতে ফিরহাদ হাকিম যে ভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন, তা অন্যায়। কোনও মন্ত্রীর এ ভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়।”
কিন্তু তাঁকে নিয়ে সমস্ত জল্পনায় জল ঢেলে দেন ববি নিজেই। তাঁর দায়িত্ব কি কমানো হয়েছে? ববি বলেন, “আমার কাছে এমন কোনও খবর নেই।” একই প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “ববির দায়িত্ব পাওয়া, দায়িত্ব ছাঁটাই হওয়া সব চিঠিই তো মনে হচ্ছে, সাংবাদিকদের পকেটে আছে! ছেপে দিলেই হল!” এই বিষয়ে পার্থবাবুর বক্তব্য, “আমি জানি না। যাঁরা বলছেন, তাঁদের কাছেই গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন।” ববিকে বীরভূমের নলহাটিতে প্রচারে যেতে বারণ করা হয়েছে বলে খবর ছড়ায়। পুরমন্ত্রী অবশ্য জানান, আজ, রবিবার তিনি নলহাটি যেতে পারেন।
ববি-প্রসঙ্গে এ দিন সংবাদমাধ্যমের কাছে কিছুটা রেখেঢেকে কথা বলেছেন রাজ্যপালও। এ দিন রাজ্যপালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “উনি (ববি) মন্ত্রিসভার সদস্য। এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” ইকবালকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে কী বলবেন? রাজ্যপাল বলেন, “জানা নেই।” রাজ্যপালের বক্তব্য সম্পর্কে পার্থবাবুর প্রতিক্রিয়া: “রাজ্যপাল যথেষ্ট বিচক্ষণ। তাঁর বক্তব্যের উপর আমি কোনও দিন কোনও মন্তব্য করিনি। করব না।”
ববির ঘনিষ্ঠ মহল এখন একটি কথা খুব পরিষ্কার বোঝাতে চাইছে যে পুরমন্ত্রী এমন কিছু করেননি, যার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবস্থা নেওয়ার কারণ ঘটেছে। এটা কি ববি দলের প্রথম সারির সংখ্যালঘু নেতা এবং গার্ডেনরিচ রাজনীতিতে মমতার ‘নির্ভরযোগ্য সৈনিক’ বলে? জবাবে ববি-ঘনিষ্ঠদের দাবি, “এ ব্যাখ্যা একেবারেই ভুল। কারণ ববি এ ভাবে সংখ্যালঘু রাজনীতি করেন না। তিনি গার্ডেনরিচে সে দিন যা করেছেন, তা আদৌ সংখ্যালঘু রাজনীতি নয়।” ববির ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “এলাকার বিধায়ক হিসাবে পুরমন্ত্রী সে দিন পরিস্থিতি সামাল দিতে গার্ডেনরিচে গিয়েছিলেন।” তা হলে ববি কেন এফআইআর-এ নাম থাকা ইকবালের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন? ববি তাঁর ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, ইকবাল তাঁর দলের পুরপ্রতিনিধি। তিনি বিধানসভা ভোট পরিচালনা করেছেন। বিধায়ক হিসেবে কাউন্সিলরকে নিয়েই রাজনীতিতে চলতে হয়। ফলে তাঁর পাশে না দাঁড়ানোর কিছু নেই। একই সঙ্গে ববির ঘনিষ্ঠদের আরও দাবি, তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। আইন আইনের পথে চলবে।
ববির ডানা ছাঁটার প্রচার কি তা হলে তৃণমূলের অন্য গোষ্ঠীর কৌশলগত চাপ? অনেকের ধারণা, দলে ও সরকারে ববির প্রাধান্য যে ভাবে বাড়ছিল, তাতে তাঁকে কিছুটা কোণঠাসা করে দিতে পারলে অন্য কোনও অংশের হয়তো সুবিধা হয়। অনেকে আবার এটাও বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ববিকে একেবারে কোণঠাসা করে দিলে মমতার পক্ষে তা ব্যুমেরাং হতে পারে। কারণ, পচনন্দা পুরমন্ত্রীর কথা শুনে ইকবালকে গ্রেফতার করেননি বলে যে অভিযোগ উঠেছিল, ববির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ব্যবস্থা নিলে তা প্রতিষ্ঠা পায়। ববিকে ‘বাঁচানোর জন্য’ই পচনন্দাকে সরানো হয়েছে। বস্তুত, এ দিনই সন্ধ্যায় মহারাষ্ট্র নিবাস হলে দলের যুব-ছাত্রদের এক গেট টুগেদার-এ একই সঙ্গে হাজির ছিলেন মমতা এবং ববি। মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছনোর কিছু পরে ববি যান মুখ্যমন্ত্রী যখন বেরোন, তখন সুব্রত বক্সী, অরূপ বিশ্বাসের মতো নেতা-মন্ত্রীরা তাঁর কাছাকাছি থাকলেও ববি ছিলেন একটু দূরে।
তবে পরিস্থিতি আপাতত যে তাঁর পক্ষে কিঞ্চিৎ ‘অনুকূল’, সেটা বুঝে ববি এ দিন একটু আক্রমণাত্মক হয়েছেন। এ দিন হাওড়ার ডোমজুড়ে তৃণমূলের এক জনসভায় তিনি বলেন, “দু’একটি ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটছে। সরকার সজাগ রয়েছে। পুলিশ, প্রশাসন, আদালত রয়েছে। অথচ আদালতে কারও বিচার হওয়ার আগে দু’একটি সংবাদমাধ্যম তো নিজেরাই বিচার করে ফেলছে।
সরকার কোনও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার আগে সংবাদমাধ্যমই সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে।”
|
মহারাষ্ট্র নিবাসে ববি-মমতা |
• মুখ্যমন্ত্রী ঢুকলেন: রাত ৭টা ৬ মিনিট
• ববি ঢুকলেন: ৭টা ৫১
• শুভাপ্রসন্নকে এগিয়ে দিতে ববি বেরোলেন: ৮টা ৪২
• মুখ্যমন্ত্রী বেরোলেন: ৯টা ১০
• সঙ্গে ববিও। তবে রইলেন একটু তফাতে |
|