সৌমীর বয়স সাত বছর। ক্লাস টুতে পড়ে। খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। স্বভাবেও বেশ শান্ত। পাড়াপ্রতিবেশী থেকে আত্মীয়স্বজন সবাই সৌমীর খুব প্রশংসা করে।
তবে, সৌমীর মা রূপাদেবীকে বলতে শোনা যায়— না, না, আমাদের সৌমীর বেশ জেদ আছে। আহ্লাদিও। বাড়ির একমাত্র মেয়ে তো। শাসন করারও উপায় নেই। অমনি ওর ঠাকুমা-দাদু রে রে করে ছুটে ওকে আড়াল করবেন।
এটা ঠিক যে সৌমী খাওয়া নিয়ে খুব ঝামেলা করে। বিশেষ করে স্কুলের টিফিন নিয়ে। ওর ঠাকুমা-দাদুও এ ব্যাপারটা স্বীকার করে নেন। এমনকী মাঝে মাঝে বিরক্তও হন।
টিফিনে ওর কোনও খাবারই ভাল লাগে না। তাই প্রায় প্রতিদিনই টিফিন ফিরিয়ে আনে। খায় না। স্কুল থেকে ফেরামাত্র সৌমীর মা সবার আগে টিফিন বক্স খুলে দেখে নেন। তার পরই বকাবকি শুরু করেন। সৌমীর তো ঠোঁটের আগায় যেন উত্তর রেডি থাকে। বলবে, ইস, জ্যাম-পাঁউরুটিটা থেকে কেমন যেন বিচ্ছিরি গন্ধ লাগছিল। কেক দিলে বলবে, এ মা কেকের ভেতরে বাদাম আর কিশমিশগুলো একদম পচা ছিল।
সকালে খুব তাড়াহুড়ো থাকে। তবু তার মধ্যে মাঝে মাঝেই ঠাকুমা চিঁড়ের পোলাও বা ছাতুর পরোটা করে দেন। তখন তাও একটু খায়। এক এক দিন পরোটার পুরোটা খায় না।
সৌমীর মা চোখ পাকিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করেন, পুরোটা খাসনি কেন? সৌমী বলবে, কী করব। খেতে খেতেই তো বেল পড়ে গেল। অত বড় পরোটা কি তাড়াতাড়ি চিবনো যায়!
ডিম সেদ্ধ দিলে কুসুমটা খাবে। সাদা অংশটা নাকি ওর বিস্বাদ লাগে। আপেল, কলা, মিষ্টি কোনও কিছুই ওর ভাল লাগে না। আঙুরটা তাও একটু খায়।
সকাল আটটায় স্কুল। বাস আসে সাতটা পনেরোতে। সকালে উঠে সৌমীর মা আর ঠাকুমা শুধু টিফিন গোছানোর জন্যেই দৌড়োদৌড়ি করেন।
তবে নুডলস আর চিপস সৌমীর খুব পছন্দের খাবার। এগুলো দিলে সৌমীর টিফিন বক্স ফাঁকা পড়ে থাকে না।
কিন্তু মুশকিল হল, স্কুলে একটা সার্কুলার দেওয়া হয়েছে। তাতে জাঙ্ক ফুড টিফিনে দিতে বারণ করা হয়েছে। যে জন্য সৌমীর সঙ্গে সঙ্গে ওর মা ঠাকুমাও পড়েছে বিপদে। টিফিনে যা-ই দেওয়া হচ্ছে সৌমীর মুখে রুচছে না।
সৌমীর ক্লাস-টিচার জয়াম্যাম খুব অমায়িক মানুষ। হাসিখুশিও। এ বারের পেরেন্টস-টিচার্স মিটিংয়ে গিয়ে সৌমীর মা ওঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। সৌমীর টিফিনের সমস্যা নিয়ে আলোচনাও করেছেন।
|
সৌমীর স্কুলের নাম রূপকথা বসু। জয়াম্যাম সব শুনে বললেন, আচ্ছা রূপকথার সঙ্গে আমি কথা বলব। ও খুব অবিডিয়েন্ট আর ইনটেলিজেন্ট। অবশ্য এ রকম সমস্যার কথা আরও কয়েক জন পেরেন্টস আমাকে বলেছেন। দেখছি কী করা যায়।
এর ঠিক ক’দিন পরেই স্কুল থেকে ফিরে সৌমী হইহই করে বলল, জানো তো ম্যাম আমাকে ক্লাসের রিসেস ইনচার্জ করে দিয়েছেন।
ঠাকুমা অবাক হয়ে বললেন, ওমা তাই নাকি? তা তোকে কী করতে হবে?
সৌমী হাত নেড়ে উত্তেজিত হয়ে বলল, ক্লাসের সবাই হাত ধুয়ে টিফিন খাচ্ছে কি না দেখতে হবে। বেল পড়ার আগে সবাই টিফিন শেষ করেছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। এমনকী টিফিনে কেউ যদি জাঙ্ক ফুড আনে, তা হলে তাকে ম্যামের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
দাদু শুনে বললেন, ওরে বাবা তোদের ক্লাসে তো অনেক স্টুডেন্ট। এত সব দেখাশোনা করতে তুই একা পারবি?
সৌমী ঘাড় নেড়ে বলল, না না আমি একা নই। আমার সঙ্গে অনুসৃতা আর ঐশীও আছে। ম্যাম বলেছেন, নেক্সট উইক-এ অন্য তিন জন ইনচার্জ হবে।
ঠাকুমা গালে হাত দিয়ে বললেন, তা হলে? এ বার কী হবে সৌমী? তুই নিজেই তো অর্ধেক দিন টিফিন খাস না। তুই তা হলে অন্যকে বলবি কী করে? লোকে কথায় বলে, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও।
ঠাকুমার কথায় সৌমী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার পর চোখ বড় বড় করে মাথা নেড়ে বলল, ইস্, ঠাকুমা তা হলে কী হবে?
ঠাকুমাও খুব চিন্তিত মুখে ঘাড় নাড়লেন।
তার পরই যেন কোনও গভীর সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে এমন ভাব করে সৌমী হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল। হাত ঘুরিয়ে বলল, ঠাকুমা বুঝলে এ বার থেকে আমার টিফিনটা চটপট খেয়ে নেব। ম্যাম বলেছেন, যে ভাল লুক-আফটার করতে পারবে, সে একটা একসেলেন্স ইন অ্যাক্টিভিটিজ-এর কার্ড পাবে। এটা কী কম কথা!
কথাগুলো বলে সৌমী প্রায় লাফাতে লাফাতে বাথরুমে চলে গেল।
সৌমীর মা রূপাদেবী সব শুনে মুখ টিপে হাসলেন। তার পরের দিন থেকে সত্যি সত্যিই সৌমী টিফিন বক্স খালি করে আনে।
দুপুরে ভাত খেতে বসে প্রতিদিনই সৌমী স্কুলের নানা গল্প করে। এই ক’দিন ও কী ভাবে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন পিরিয়ডটা দেখাশোনা করে, সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছে। ওর বন্ধু অস্মিতা এক দিন চাউমিন এনেছিল। হলের কর্নারে হাত চাপা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছিল। অনুসৃতা আর ঐশী দেখেও বুঝতে পারেনি। কিন্তু সৌমীর চোখে কী ভাবে ধরা পড়েছিল সে গল্পও ও উত্তেজিত হয়ে বলেছিল।
সৌমীর কথাগুলো ওদের বাড়ির সবাই খুব উপভোগ করে।
সে দিন তো সৌমীর কথা শুনে সবাই চমকেই গেল। হয়েছে কী, অনেক দিন পর সৌমীর মাসিমণি এসেছেন। তা সৌমীকে ডেকে হাতে একটা বড় চিপসের প্যাকেট দিলেন। সৌমী ঘাড় নেড়ে বিজ্ঞের মতো বলল, জানো তো মাসিমণি, চিপস খাওয়া শরীরের পক্ষে খুব খারাপ। খেতে ভাল লাগে ঠিকই। কিন্তু এগুলো খেলে শরীরের মধ্যে কত রকম রোগের যে বীজ পুঁতে দেয় তা জানলে চমকে উঠবে।
সৌমীর মাসিমণি অনুরাধাদেবী কপট বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, এ মা তাই নাকি? ইস্, তোর বুবুইদাদা আর টুবুইদাদা তো চিপস পেলে আর কিচ্ছু চায় না। তুই ওদের একটু বুঝিয়ে বলিস তো।
সৌমী বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নেড়ে ওর দাদাদের সন্ধানে উঠে পড়ল।
অনুরাধাদেবী অবাক হয়ে সৌমীর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রে রূপা, ব্যাপারটা কী? যে মেয়ে চিপসের এত ভক্ত ছিল, সে মেয়ে চিপস খাচ্ছে না! এ তো দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম! কী ম্যাজিক করেছিস রে!
রূপাদেবী হেসে বললেন, দিদি, এই ম্যাজিকের রহস্যটা পরে তোকে বলছি। এখন চল তো সৌমী বুবুই-টুবুইকে কী রকম বোঝাচ্ছে দেখে আসি। |