এক দিকে, বিপুল বেকারত্ব। অথচ অন্য দিকে, দক্ষ কর্মী পেতে মাথা খুঁড়ছে শিল্প। কাজের সুযোগ বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে তার দরজা খুলে দেওয়া যাচ্ছে না কর্মপ্রার্থীদের সামনে। বিশেষ করে স্কুল বা কলেজের গণ্ডি না-টপকানো সাধারণ শিক্ষিতদের কাজের বাজারে।
আর ঠিক এইখানেই নিজেদের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগ। চেষ্টা করছে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতার সেতু তৈরির। যাতে তা মিলিয়ে দিতে পারে কাজ আর কর্মপ্রার্থীকে। দক্ষ কর্মীর চড়া চাহিদার কারণে এই বাজার এখন লোভনীয়। এতটাই যে, রাজ্য-সহ পূর্ব ভারতের বাজার ধরতে গত বছরই কলকাতায় শাখা খুলেছে বিলেতের বোর্নভিল কলেজ। কর্মমুখী প্রশিক্ষণের জন্য পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত ১০০ বছরের পুরনো ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান।
আবার সেই চাহিদার দৌলতেই কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে স্কুল ফর স্কিলস্ ইন অ্যালায়েড হেল্থ সায়েন্সেস। ইতিমধ্যেই শালবনিতে জিন্দল স্টিলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেছে তারা। এ মাসেই বীরভূম জেলার সিউড়িতে চালু হতে চলেছে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আই-কেয়ারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড়া ওই কেন্দ্রে প্রাথমিক ভাবে পড়ানো হবে তিনটি বিষয় হেল্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট, এমার্জেন্সি মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান এবং অপারেটিং থিয়েটার টেকনিশিয়ান।
স্কুলের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন শতদল সাহার দাবি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ অনুমোদিত এই প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক ধারণাগুলির সঙ্গে পরিচিতির পর হাতে-কলমে কাজ শেখার সুযোগ মিলবে। করানো হবে ইন্টার্নশিপও। এর পর ভোপাল এবং ছত্তিশগঢ়েও একই রকম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলতে চান তাঁরা।
উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে যে কাজের সুযোগ পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট সিআইআইয়ের সমীক্ষাতেই। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালের মধ্যে রাজ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লক্ষ ৩০ হাজার। শুধু উৎপাদন শিল্প, পরিষেবা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রেই কাজের সুযোগ তৈরি হবে ৪ লক্ষ ১০ হাজার। যার একটা বড় অংশের জন্য যোগ্য লোক খুঁজে পেতে নাজেহাল হবে শিল্প।
সিআইআই (পূর্বাঞ্চল) এবং বেঙ্গল চেম্বারের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট অলোক মুখোপাধ্যায়ের মতে, “সংস্থা যা চায় আর নতুন কাজে যোগ দেওয়া এক জন কর্মী যা পারেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার ফারাক বিস্তর।” তাঁর মতে, ওয়েল্ডিং কারিগর হোক কিংবা নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট। এঁদের কাজ আপাত দৃষ্টিতে সরল-সোজা মনে হলেও, যথেষ্ট সংখ্যায় তাঁদের খুঁজে পাওয়া ভার। অথচ এই সব কাজে দক্ষ কর্মী পাওয়া জরুরি। বিশেষত আজকের উন্নত প্রযুক্তির দুনিয়ায়। কারণ, শুধু ‘আইডিয়া’ দিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘোরে না। কাজের জায়গায় তা হাতে-কলমে প্রয়োগ করেন কর্মীরাই। তাই সেখানে ঘাটতি হলে, বৃদ্ধির চাকায় গতি কমে।
বোর্নভিল কলেজের ডিরেক্টর (দক্ষিণ-এশিয়া উন্নয়ন) সুদেষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের মতে, দক্ষতার ঘাটতি সর্বত্র। তবে এই সমস্যা সব থেকে বেশি, নির্মাণ শিল্প, আতিথেয়তা বা আপ্যায়ন -জনিত পরিষেবা (যেমন, হোটেল), স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
খনন কর্মী, ওয়েল্ডিং মেকানিক, ইলেকট্রিশিয়ান ইত্যাদি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার কথা ইতিমধ্যেই বহু বার বলেছে শিল্প। এ নিয়ে বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে প্রশিক্ষণও চালু করেছে সিআইআই ও বোর্নভিল কলেজ। এখন এর পাশাপাশি একই রকম গুরুত্ব পাচ্ছে স্বাস্থ্য পরিষেবায় দক্ষ কর্মীর সংখ্যায় টানের বিষয়টি।
সিআইআইয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৫-র মধ্যে ৫-৭ হাজার এমবিবিএস/ এমডি ডাক্তারের ঘাটতি হবে রাজ্যে। নার্স কম পড়বে ২০-৩০ হাজার। প্রয়োজন হবে বিপুল সংখ্যায় ‘সাপোর্ট স্টাফ’ও। যেমন, হেল্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট, এমার্জেন্সি মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান, অপারেটিং থিয়েটার টেকনিশিয়ান, নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ইত্যাদি।
শতদলবাবুর মতে, প্রতি ১০০ হাসপাতাল বেডের জন্য অন্তত ৩৫০ কাজের সুযোগ তৈরি হয়। এর ১২০ -১৩০ জনই সাপোর্ট স্টাফ। আগামী ১০ বছরে রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবায় ৭৪ হাজার কাজের সুযোগ তৈরি হবে বলে তাঁর দাবি।
স্বাস্থ্য পরিষেবায় এই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই রাজ্যে এ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে সিআইআই। শীঘ্রই এ জাতীয় পাঠ্যক্রম চালু করতে চলেছে বোর্নভিল কলেজও। |