সারা দিন ধরে পিল পিল করে আসছেন মানুষ। রাতেও আসছেন মোমবাতি হাতে। গন্তব্য একটাই, শাহবাগ স্কোয়ার।
নিজের ব্লগে রাজাকারদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে খুন হওয়া তরুণ স্থপতি রাজীব হায়দারের দেহ বিকেলে এসে পৌঁছল এই ‘স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বরে।’ সেই দেহকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় মুড়ে রাখা হয়েছে। শোকস্তব্ধ নিস্তব্ধ জনতা। নামাজ-ই-জানাজার পরে হল শেষ প্রার্থনা সভা। হাজার হাজার মানুষ, স্তব্ধ। কোনও হুড়োহুড়ি নেই। শুধু সকলের বুকে-মাথায় কাপড়ে বাধা স্লোগান ফাঁসি চাই। ফাঁসি চাই। ফাঁসি চাই।
শাহবাগ থেকে ফাঁসির এ দাবি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বাংলাদেশে। সর্বত্রই অরাজনৈতিক মানুষের সভা। শুধু নবীন প্রজন্মই নয়, বৃদ্ধ থেকে গৃহবধূ সকলেই হাজির। ফুটপাথে সন্তানকে বসিয়ে মা তাঁর সন্তানের মাথায় ফেট্টি বেঁধে দিচ্ছেন, তাতে লেখা ‘ফাঁসি চাই’। তাহরির স্কোয়ারে গণবিক্ষোভ দেখেছে মানুষ। তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের বিদ্রোহও দেখেছে। দিল্লির যন্তরমন্তর বা ইন্ডিয়া গেটেও দেখা গিয়েছে মোমবাতি মিছিল। কিন্তু গত দু’দশকে মানুষ এমন বিক্ষোভ দেখেনি। |
নিহত রাজীবের কফিন পৌঁছল শাহবাগ স্কোয়ারে। শনিবার। ছবি: এএফপি |
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ছুটে গিয়েছেন নিহত রাজীবের বাড়িতে। তার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, জামাতে ইসলামি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। সন্ত্রাসই তাদের পথ। বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনও অধিকার জামাতের নেই। হাসিনা বলেছেন, “এই সন্ত্রাসীদের যা করা দরকার, আমরা সেটাই করব।” তাঁর এই মন্তব্যের পরেই প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি বাংলাদেশ সরকার জামাতকে নিষিদ্ধ করতে চলেছে? বৈঠকের পর দুই বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ ও দীপু মণি যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এই গণআন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। জামাতকে নিষিদ্ধ করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীও। তাঁর কথায়, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। আর সলমন খুরশিদ এই রকম একটি দিনে ঢাকায় এসে যে ভাবে একাত্তরের বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সলমন বলেছেন, “নবীন প্রজন্মের দাবিও যুক্তিসঙ্গত।” সন্ত্রাসের বিরোধিতা করে ধর্মনিরপেক্ষতার অভিমুখে দু’দেশের এগিয়ে চলার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। দীপু মণি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়াই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু তার পর একের পর এক পটপরিবর্তন ঘটে গিয়েছে বাংলাদেশে। মুজিবর রহমান নিহত হয়েছেন, সেনাকর্তারা ক্ষমতা দখল করে অসামরিক শাসক সেজে বসেছিলেন দীর্ঘদিন। তাঁরাই ধর্মনিরপেক্ষতা অর্জনে বাধা দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশের এই সরকার।
উত্তাল এই গণবিদ্রোহ শুধু জামাতকে নয়, বুঝি কোণঠাসা করেছে বিএনপিকেও। প্রধান এই বিরোধী দল অভিযোগ করছে, বিরোধীদের জোট ভাঙার জন্য এই সমাবেশ আসলে এক সরকারি চক্রান্ত। কিন্তু ১৩ দিন ধরে চলা এই আন্দোলনে যে ভাবে সাধারণ মানুষ যোগ দিচ্ছেন, এই অভিযোগ তাতে নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। এই আন্দোলনের সাফল্যের পিছনে যে বিপুল আবেগ ও জনসমর্থন রয়েছে, তা নিয়ে এখন আর কোনও সংশয় নেই। অণ্ণা হজারে বা রামদেবের নেতৃত্বে নাগরিক বিক্ষোভ যেমন সরকারবিরোধী ছিল, এখানে কিন্তু তা নয়। সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এই বিক্ষোভ মঞ্চে এসে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলছেন, “আমি এখানে, কিন্তু আমার মন পড়ে রয়েছে ওখানে (শাহবাগ স্কোয়ারে)।” শনিবারেও বিক্ষোভ সমাবেশে এসে স্লোগান দিয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রবাসী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দেখা করে সংহতি জানিয়ে আসছেন মন্ত্রীরা। আজ এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন আওয়ামি লিগের ছাত্র সংগঠনও।
শাহবাগের অনতিদূরে চলছে একুশের বইমেলা। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে জাতি তৈরি হয়েছিল, আজ সেই জাতি আবার এক নতুন বিক্ষোভের রাস্তায় এক নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাইছেন। দু’সপ্তাহ পার হতে চলা এই আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা অপ্রত্যাশিত। সভায় যোগ দিতে আসা এক জন জানাচ্ছিলেন, “অটো করে এসেছি অনেক দূর থেকে। শাহবাগে আসছি শুনে অটোচালক আমার কাছ থেকে ভাড়াই নিলেন না।” কথা ছিল ধীরে ধীরে আন্দোলনের সময়সীমা কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজীবের ভয়ানক হত্যাকাণ্ড ওই আন্দোলনকে ফের উস্কে দিয়েছে। বাড়ি ফেরার সময়ে আততায়ীরা তাকে কোপায়, তার পরে গলা কেটে দেয়। শাহবাগ বিক্ষোভের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বছর আঠাশের এই স্থপতি। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবা আক্ষেপ করেছেন, “আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কিন্তু দেশকে রাজাকার-মুক্ত করতে পারিনি। সে পাপেই ছেলেকে খুন হতে হল!”
তবে ওই আন্দোলন বাংলাদেশকে কোন পথে নিয়ে যাবে শেখ হাসিনার কাছে সেটাও একটি চ্যালেঞ্জ। আন্দোলনকারীদের দাবি পূরণ করতে গেলে একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসি নিশ্চিত করতে হবে। জামাতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। বার কয়েক ক্ষমতায় এসেও এই কাজ আওয়ামি লিগ করে উঠতে পারেনি।
এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ‘সনস অফ বাবর’ নাটকের নাট্যকার সলমন খুরশিদ আন্দোলন প্রাঙ্গণ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে একটি হোটেল মধ্যাহ্নভোজন করতে করতে বললেন, “আধুনিক বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া বিকল্প পথ নেই।” অণ্ণার আন্দোলন নিয়ে নয়াদিল্লি যে অবস্থানই নিক, বাংলাদেশের এই গণজোয়ারের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সহানুভূতি জানাতে কিন্তু গলা কাঁপেনি খুরশিদের। |