রাজনৈতিক হিংসার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনও পরিবর্তন দেখছে না কেন্দ্র। বাম আমলের মতো তৃণমূলের আমলেও যে ভাবে রাজনৈতিক হানাহানি চলছে তাতে, রাজ্যের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন রাজনৈতিক হিংসা-মুক্ত হবে কি না, তা নিয়ে ঘোর সংশয়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
এই উদ্বেগের কারণ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট। এই সব রিপোর্ট খতিয়ে দেখে কেন্দ্র মনে করছে, রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাতে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলায় জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা বাড়বে। কারণ বিধানসভা নির্বাচনের পরে বেশ কিছুটা সময় কেটে গিয়েছে। সিপিএম ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এ দিকে তৃণমূল ও কংগ্রেসের মধ্যেও রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াই চলছে। এই গণ্ডগোলের সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে মাওবাদীরাও। ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা সীমান্ত দিয়ে ফের মাওবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। রাজ্যপাল নিজেই তাঁর রিপোর্টে এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
গত কাল যে ভাবে কলকাতায় কলেজ নির্বাচনকে ঘিরে অশান্তির জেরে এক পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়েছে, তাতে তাঁদের আশঙ্কাই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। রাজনৈতিক হিংসার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই অন্যান্য রাজ্যগুলির শীর্ষে। নর্থ ব্লক সূত্রের বক্তব্য, রাজ্যে যে সব খুনের ঘটনা ঘটে, তার চার ভাগের এক ভাগ খুনোখুনি হয় রাজনৈতিক কারণে। অন্যান্য রাজ্যে মূলত সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, ব্যক্তিগত শত্রুতা, জাতপাতের বিবাদ, পরিবারের অমতে বিয়ে করার মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা ঘটে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে সব থেকে বেশি খুনের ঘটনা ঘটে রাজনৈতিক হিংসাকে কেন্দ্র করে। বামফ্রন্ট জমানা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্ব, এ বিষয়ে অন্তত কোনও ‘পরিবর্তন’ ঘটেনি। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় প্রথম পাঁচ মাসে শুধু ছাত্র-রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই প্রায় সাড়ে ছ’শো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক সংঘর্ষে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় হাজার খানেক রাজনৈতিক কর্মী আহত হয়েছেন। যার মধ্যে শ’দেড়েক ছাত্রছাত্রীও রয়েছেন। |
একই কথা বলছে ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-র তথ্যও। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে খুনোখুনির ৩০.৬ শতাংশ হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। ২০১১ সালে ২৫.৯ শতাংশ খুনের পিছনেও ছিল রাজনৈতিক কারণ। ২০১২ সালের হিসেবনিকেশ এখনও চলছে। তবে ছবিটা বিশেষ বদলাবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ প্রতি মাসে গড়ে অন্তত একশোটি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে। রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এই পরিমাণ রক্তক্ষয় উত্তরপ্রদেশের মতো হিন্দিবলয়ের রাজ্যগুলিতেও ঘটে না বলে জানাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। তাঁদের হিসেব বলছে, এ ক্ষেত্রে বিহার, মধ্যপ্রদেশকেও প্রতি বছর অনেক পিছনে ফেলে দেয় পশ্চিমবঙ্গ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষস্থানীয় এক অবাঙালি কর্তা বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের নাম শুনলেই সে রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা মনে আসে। তার সঙ্গে এই রাজনৈতিক খুনোখুনি, এ এক প্রবল বৈপরীত্য।”
কেন এত রাজনৈতিক খুনোখুনি ঘটে এই বাংলায়?
রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি ভূপেন্দ্র সিংহের মতে, যে কোনও বিষয়ের রাজনীতিকরণই এর প্রধান কারণ। তা সে পাড়ার ফুটবল ম্যাচই হোক বা স্কুল-কলেজের নির্বাচন, সব কিছুতেই রাজনীতির রং লেগে যায়। আগেই প্রশ্ন উঠে যায়, কে কোন দলের লোক। সিপিএম হোক বা তৃণমূল, কেউই তার ব্যতিক্রম নন। ভূপেন্দ্র বলেন, “আমি যে শহরের বাসিন্দা, সেই চণ্ডীগড় বা দিল্লির মতো শহরে এটা ভাবাই যায় না। অথচ পশ্চিমবঙ্গে কাকে চাকরি দেওয়া হচ্ছে, কে সরকারি ভাতা পাচ্ছে, কোথায় নতুন প্রকল্প হচ্ছে, সবেতেই রাজনীতি। তাই শিক্ষাক্ষেত্র থেকে কর্মক্ষেত্র, রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কখনও সেটা তর্কাতর্কি, বাদানুবাদে সীমিত থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেটাই হানাহানির পর্যায়ে চলে যায়। গত ৪০-৫০ বছর ধরেই এটা হয়ে আসছে। আমার মনে হয়, রাজনীতিরও তার নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে থাকা উচিত।”
কলকাতার রাজভবনে যাওয়ার পর এম কে নারায়ণনও এই সারসত্য বুঝতে পেরেছেন। তাই বারেবারেই তিনি রাজনৈতিক গুণ্ডামির বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন। কলেজ নির্বাচনের রাজনীতিকরণ ও ক্যাম্পাসের হিংসা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কেন্দ্রীয় সরকারকে পাঠানো রিপোর্টেও তার সেই উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। প্রতি মাসে রাজ্যপাল যে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন, সেখানে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তিনি। তৃণমূল নেতৃত্ব বলছে, রাজনৈতিক হিংসার ৩৪ বছরের সংস্কৃতি দেড় বছরে পাল্টে যাবে, তা হতে পারে না।
এখন যার রাজত্বে খুনোখুনি চলছে, বাম-জমানায় সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে বারবার কেন্দ্রের শরণাপন্ন হয়েছেন। নরসিংহ রাওয়ের জমানায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চহ্বাণ, রাজীব গাঁধীর আমলে বুটা সিংহর কাছে একাধিক বার পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি জানিয়েছেন তিনি। এনডিএ-জমানায় লালকৃষ্ণ আডবাণীকেও মমতার এই দাবি শুনতে হয়েছে। সংবিধানের ৩৫৫ ও ৩৫৬ নম্বর ধারা প্রয়োগের দাবিতে সরব হয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় ইউপিএ-সরকারে পি চিদম্বরমের কাছেও তৃণমূল একই অভিযোগ তুলেছে।
বিধানসভা ভোটের মুখে খুনোখুনির জেরে এ রাজ্য পেয়েছে ‘বধ্যভূমি’-র তকমাও। এখন আবার তৃণমূলের সন্ত্রাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হচ্ছেন বাম নেতারা। যদিও সিপিএম নেতৃত্ব আপাতত মমতার সরকার তথা প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমজনতার ক্ষোভকেই আরও উস্কে দিতে চাইছেন। তাই তাঁরা
এখনই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের দাবি জানাতে চাইছেন না। সিপিএম নেতা নীলোৎপল বসু বলেন, “কেন্দ্রে কাছে যাওয়ার দরকার কী! রাজ্যের মানুষই এর জবাব দেবেন।” |