লাফিয়ে উঠছে স্লোগান। ফুলে উঠছে গলার শির। বাতাসে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। ছেলেটা বলছে প্রতিজ্ঞা করুন, এই সংগ্রাম চলবে...
আর ক্যাম্পাসের কোণে জারুলের নীচ থেকে তাকে দেখছে করুণ এক জোড়া চোখ। হঠাৎই ছেলেটার চোখ পড়ল সে দিকে। সংগ্রামের নিশানে লেগে গেল বিন্দির রং...
ছাত্র রাজনীতির আঁচ তো শুধু পরের প্রজন্মের ডাকসাইটে নেতা-নেত্রী নয়, দিয়ে গিয়েছে বহু অনিমেষ আর মাধবীলতাকেও। দাস ক্যাপিটাল বা গাঁধীর ছবিতে হাত রেখেও যারা আলগোছে জড়িয়ে নিয়েছে রঙিন উত্তরীয় ‘বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই’। প্রেসিডেন্সি, সুরেন্দ্রনাথ, নরসিংহ দত্ত কলেজ ছেড়ে গ্রামে-গ্রামান্তরে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া নকশাল ছেলেমেয়েদের কথা না হয় বাদই রইল। মূলস্রোতেও তো নমুনা কম নেই।
এক কালের ছাত্র ফেডারেশন নেতা শ্যামল চক্রবর্তী (এখন সিটু-র রাজ্য সভাপতি) যদি শিপ্রা ভৌমিকের প্রেমে পড়ে থাকেন, তো সহপাঠিনী ছন্দবাণীর দিকে চোখ রেখেই তেরঙ্গা দুলিয়ে গিয়েছেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র, বর্তমানে পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সুভাষ-জায়া রমলা চক্রবর্তীর হয়তো এখনও একলা দুপুরে মনে পড়ে কলেজ জীবনের সেই দুপুরের কথা। নব্বইয়ের শেষে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভানেত্রী প্রেমে পড়েছিলেন সংগঠনের সহ-সভাপতির। দু’বছর বাদে বিয়ে। প্রথম জন, সোনালি গুহ এখন বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার। আর তাঁর স্বামী পার্থ বসু কলকাতার ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের (কলেজ স্ট্রিট এলাকা) কাউন্সিলর। |
স্কুল ছেড়ে কলেজে আসা মানে তো নদীর মাছ সমুদ্রে এল। ছোটবেলার বন্ধুদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার দুঃখ কখন যেন হারিয়ে যায় ক্যান্টিনে, কমন রুমে। কয়েক দিন আগেও খবরের কাগজে শুধুই ‘খেলার পাতা’ পড়া ছেলেটি বা টিভি সিরিয়ালে মগ্ন মেয়ে মিছিলে-স্লোগানে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে ছাত্র রাজনীতিতে। ক্লাস কামাই করে পোস্টারিং, মিছিল, মিটিংয়ের মাঝেই তৈরি হয় বন্ধুত্ব। আর তা থেকেই...
হাওড়া জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি অনুপম ঘোষের মতে, “এই ধরনের সম্পর্ক বেশির ভাগ সময়েই শুধু আবেগের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে।” তিনি নিজে বউ পেয়েছেন ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়েই। এসএফআইয়ের হাওড়া জেলা সম্পাদক বিশ্বরূপ ঘোষের ব্যাখ্যা, “ভালবাসাই অনেককে নতুন কিছু ভাবতে বা করতে উৎসাহিত করে।” প্রেসিডেন্সির আইসি নেতা অম্লান হাজরা বলেন, “ভিন্ন সংগঠনের ছাত্রছাত্রীদের প্রেমও হয় আকছার। বছরভর ক্যাম্পাসে এক সঙ্গে থেকেও ভোটের সময়ে তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েন। ব্যক্তিগত সম্পর্কে তার প্রভাব পড়ে না।”
ফুল যত না ফুটেছে, কাঁটাই অবশ্য ফুটেছে বেশি।
সত্তর দশকের এক দুপুরে যেমন শুরু হয়েছিল এক গল্পের। যে দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে গণিত বিভাগের ক্লাসে ঢুকে পড়েন ছাত্র পরিষদের দাপুটে নেতা তথা ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর চোখে চোখ রেখে বলেন, ‘ক্লাসের পরে বাইরে দেখা কোরো।’ তৃতীয় বর্ষের সেই ছাত্রের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল মেয়েটি। নদিয়ায় ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত প্রায় সকলেই জানতেন তাঁদের সম্পর্কের কথা। যদিও তাঁদের জীবনের অঙ্ক মেলেনি।
সেই আগুনখোর ছাত্রনেতা আজ বৃদ্ধ। কর্মজীবন থেকে অবসর নেবেন আর মাত্র কয়েক দিন পরেই। কিন্তু এখনও পাড়ার মোড়ে বা কোনও বাড়ির ভিতর থেকে ‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম, চললাম’ ভেসে এলে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি। মনে পড়ে যায়, প্রেমিকার বিয়েতে রজনীগন্ধার গোছা হাতেই হাজির হয়েছিলেন তিনি। এই প্রেমের কথা এখনও শোনা যায় কান পাতলে।
এখন ফুলের বদলে ফেসবুক এসেছে। বসন্ত কেবিনের জায়গায় বারিস্তা। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আগে ভোট টানতে প্রেমের ভান এসেছে। অনার্স পাইয়ে দেওয়া, ফি মকুব বা নিছকই কলেজের অনুষ্ঠানে বাড়তি কার্ডের বিনিময়ে শরীরী ঘনিষ্ঠতা।
এ সব তুচ্ছ গোলযোগে কবেই বা হৃদয়ের সানাই থেমেছে? ভয় তো শুধু দলাদলি নিয়ে। যে ভয়ে হয়তো আজও প্রেসিডেন্সির দেওয়ালে পোস্টার পড়ে “ভালবাসার আগে প্রশ্ন করো, তুমি কোন দল? তুমি কোন দল?” |