মূল্যবোধ হারাল কোথায়, সেঞ্চুরি পেরিয়ে প্রশ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামীর
নেতাজির সংস্পর্শে এসেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ে। তার পরেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ। রাজনীতি করেছেন সাতের দশক পর্যন্ত। তার পরে অবসর নিলেও রাজনীতির চর্চা এখনও তাঁর খুব প্রিয় বিষয়। একশো বছর বয়স পূর্ণ করার দিনে এ হেন মানুষটির উপলব্ধি, “আমাদের সময়ে নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ ছিল। এখন তা কোথায়!”
১৯১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কাটোয়ার শ্রীখণ্ড গ্রামে জন্মেছিলেন নিত্যানন্দ ঠাকুর। তাঁর জন্মশতবর্ষিকী উপলক্ষে কংগ্রেস-সহ নানা সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। কিন্তু পাঁচ দিন আগে ভোরবেলায় পড়ে গিয়ে জখম নিত্যান্দবাবু মঙ্গলবার পর্যন্ত নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন। তাই সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। তবে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোয় ছেদ পড়েনি। সকাল থেকেই কাতারে কাতারে মানুষ ফুল, মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছেন তাঁর কাছে।

জন্মদিনে নিত্যানন্দ ঠাকুর।
১৯৬৯ সালে নিত্যানন্দবাবু কাটোয়ার বিধায়ক হন। তিন বছর পরে ১৯৭২-এ কংগ্রেসের ‘গোষ্ঠী রাজনীতির’ জন্য ভোটে দাঁড়াননি। ১৯৭৭-এ জনতা দলের হয়ে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। নিত্যানন্দবাবুর কথায়, “এর পর থেকে মূল্যবোধ কমতে থাকে। তাই রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসি। বৈষ্ণব ধর্ম চর্চায় মনোযোগ দিই।” তাঁর পরিবারের লোকজন জানান, ১৯৮০ সালের পর থেকে নিত্যানন্দবাবু রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
তবে রাজনীতির চর্চা করতে এখনও ভালবাসেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামী। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর গোচরে রয়েছে। চোখে ভাল দেখতে পান না। টেলিভিশন, রেডিওর খবর শোনেন মন দিয়ে। তবে মনে এখন তাঁর বেশ বিতৃষ্ণা। বলছেন, “এখনকার রাজনীতি নিয়ে আর কী বলব! কিছুই বলার নেই। নেতাদের মনের পরিবর্তন না হলে রাজ্যের পরিবর্তন হবে কী ভাবে?” রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পরে ধর্মচর্চা ও সমাজসেবার মধ্যেই নিজেকে যুক্ত করে রেখেছিলেন নিত্যানন্দবাবু। তাঁর উপলব্ধি, “সমাজসেবা ও রাজনীতি এক সঙ্গে করা যায় না, বোঝা উচিত ছিল। তবে আবার সমাজসেবা না করলে তো রাজনীতিও করা যায় না।”
নিত্যানন্দবাবুর পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে। তাঁদের অধিকাংশই কলকাতায় থাকেন। বড় ছেলে পবিত্রানন্দ ঠাকুর প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। বছর দুয়েক আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। বুধবার নিত্যানন্দবাবুর ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি-সহ পরিজনেরা শ্রীখণ্ডে এসেছেন। বাড়ির লোকজন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন। এক ছেলে অসীমানন্দবাবুর দাবি, “চোখের অস্ত্রোপচার ছাড়া বাবাকে কোনও দিন হাসপাতাল-নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়নি। একশো বছর পূর্ণ করার আগে করতে হল। হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ায় তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যান। পা ভেঙে যায়।”
সারা জীবন নিরামিষ আহার করেছেন নিত্যানন্দবাবু। পরিবারের সদস্যেরা জানালেন, এখনও তিনি পরিমিত আহারই করেন। ফল, মুড়ি, রুটি, ভাত ও সব্জি, খাদ্যতালিকা বলতে এটুকুই। এত দিন সুস্থ থাকার রহস্য প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “আমি কোনও দিন খেলাধুলো, শরীরচর্চা করিনি। তবে নিয়মিত পরিমিত আহার। অসংখ্য মানুষের ভালবাসাও বেঁচে থাকার রসদ জোগায়।” দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁকে কাছ থেকে দেখা চিকিৎসক শীতল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “উনি জমিদারবাড়ির ছেলে হলেও জনদরদি।”

জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে পঙ্ক্তিভোজ।
নিত্যানন্দবাবু বলেন, “আমার রাজনৈতিক জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সিপিএম নেতা হরমোহন সিংহ। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনও দিন বৈরিতা ছিল না। ব্যক্তিগত ভালবাসা ছিল সব সময়।” রাজনীতি ছেড়ে হরমোহনবাবুও এখন সমাজসেবী। তিনিও মনে করেন, “সমাজসেবার ক্ষেত্রে রাজনীতি বাধা তৈরি করে।” শতবর্ষে এসে নিত্যানন্দবাবুর মনে পড়ছে, সুভাষচন্দ্র বসু, গাঁধীজি, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গাঁধী, প্রফুল্ল সেন, অতুল্য ঘোষদের কথা। তাঁর বক্তব্য, “ওঁরা কত ত্যাগ করে রাজনীতি করেছিলেন। আর এখন নেতা-কর্মীদের স্বার্থপরতার জন্য দল মুখ থুবড়ে পড়ে।” ১৯৫৩ সালের ২ অক্টোবর ‘সর্বোদয়’ নামে একটি স্থানীয় পত্রিকা প্রকাশ করেন নিত্যানন্দবাবু। ১৯৭৪ অবধি তাঁর সম্পাদনায় নিয়মিত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, “রাজনীতির কথা বলার জন্য একটি পত্রিকার প্রয়োজন ছিল। সে কারণেই পত্রিকাটি প্রকাশ করা হত।”
কোনও স্মরণীয় ঘটনার কথা মনে পড়ে, জিজ্ঞাসা করতেই বলে উঠলেন, “মহাজাতি সদনের ভিত্তি স্থাপন হচ্ছে। তখন আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। নেতাজি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশাপাশি বসে। আমি তাঁদের পায়ের কাছে বসেছিলাম। ওই দৃশ্যটা ভুলতে পারি না।”
—নিজস্ব চিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.