এটাই কি চির-চেনা মোহন-ইস্ট ডার্বি? ছবিগুলো একেবারে অচেনা ঠেকছে! অন্তত যুবভারতীতে প্রথম বাঁশি বাজার ২৪ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত। গত দু’মাস ধরে চরম অনিশ্চয়তার সুতোয় দুলতে থাকা বাঙালির ফুটবল উৎসব ফিরে আসছে নজিরবিহীন ভোলবদলে ভর করে।
ঝটিতি ফেরা যাক এ যাবৎকালের সর্বশেষ ডার্বিতে। ২০১২-র ৯ ডিসেম্বর। দর্শকের ঢিলে রহিম
নবির মাথা ফেটে রক্ত, গ্যালারিতে পুলিশের বেধড়ক লাঠি, বিরতিতে মোহনবাগানের দল তুলে নেওয়া। তারও পরে ফেডারেশনের নিদানে মোহনবাগানের নির্বাসন এবং চমকপ্রদ প্রত্যাবর্তন।
এবং প্রত্যাবর্তন ডার্বিরও। সঙ্গে প্রত্যয় কলঙ্কের ছিটেফোঁটাও যেন আর ছুঁতে না পারে ৯ ফেব্রুয়ারির যুবভারতীকে।
তাই নিরাপত্তা আর পেশাদারিত্বের মিশেলে শনিবার এক অন্য ডার্বির অপেক্ষা। দফায় দফায় দুই প্রধানের কর্তা, পুলিশ, ফেডারেশন প্রতিনিধিদের বৈঠকের পর যে রণসজ্জা হচ্ছে, তা সব অর্থেই নজিরবিহীন। নিরাপত্তা বলয়ে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে যুবভারতীকে। ত্রিস্তর টিকিট চেকিং থেকে গ্যালারিতে সাদা পোশাকের পুলিশ, ক্লোজড সার্কিট টিভি, আগের চেয়ে দ্বিগুণ পুলিশ কর্মী মোতায়েন বাদ যাচ্ছে না কিছুই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে ফেডারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন সিকিমের এক দুঁদে পুলিশ অফিসার। আই লিগের ইতিহাসে প্রথম বার দেশের চার রাজ্য থেকে চার ফিফা রেফারিকেই উড়িয়ে আনা হয়েছে ওডাফা-চিডিদের সামলাতে। |
স্টেডিয়ামের একটা বড় অংশ শনিবার ফাঁকা পড়ে থাকবে। কারণ, ম্যাচের সংগঠক মোহনবাগান এক লাখ দশ হাজার আসনের স্টেডিয়ামের জন্য মাত্র সত্তর হাজার টিকিট বাজারে ছেড়েছে। মোহন-কর্তাদের দাবি, নিরাপত্তার কথা ভেবেই দর্শক সংখ্যা কম রাখতে চাইছেন তাঁরা। ডার্বির ইতিহাসে এ বারই সব থেকে দামি টিকিট। সর্বনিম্ন দু’শো, সর্বোচ্চ পাঁচশো টাকার। তা-ও বিক্রি হচ্ছে হুহু করে। ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে দুই প্রধানের তাঁবুর গেটে টিকিটের সঙ্গে বিলি হচ্ছে আবেদন ‘১৬ অগস্ট ১৯৮০ ফিরে আসতে দেবেন না।’
ম্যাচের আগের দিন সাংবাদিক বৈঠকে মর্গ্যান এবং করিম দুই কোচের কাছে স্ট্র্যাটেজি নিয়ে যত প্রশ্ন এসেছে, তার চেয়ে বেশি প্রশ্ন নিজেদের ফুটবলার আর সমর্থকদের শান্ত রাখতে তাঁরা কী বার্তা দিচ্ছেন, তা নিয়ে। এমনিতে মর্গ্যান-করিম সম্পর্ক ইপিএলের মাঠে ফার্গুসন- মোরিনহোর চেয়েও তিক্ত। দু’জনে দু’জনের নাম মুখে আনেন না। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাকানও না পরস্পরের দিকে।
ইডেনের ১৬ অগস্ট দু’জনেই শুনেছেন। দেখেননি। তাঁদের বরং এখনও তাড়া করে ফিরছে দু’মাস আগের কলঙ্কিত ডার্বির আতঙ্ক। শুক্রবার সকালে নিজেদের প্রথম একাদশ নিয়ে ধোঁয়াশা রাখলেও সমর্থকদের জন্য প্রায় একই রকম বার্তা দিয়েছেন যুযুধান দুই কোচ।
মর্গ্যান বলেছেন, “মাঠে আসুন, খেলা দেখুন। কিন্তু দোহাই কেউ স্ট্রেচারে বা অ্যাম্বুল্যান্সে করে হাসপাতাল বা বাড়িতে ফিরবেন না।” করিমের বার্তা, “সবাই দল বেঁধে মাঠে আসুন। আমাদের সমর্থন করুন। এখন টিমের ভালর জন্য আপনাদের সমর্থন দরকার। কিন্তু প্ররোচনায় পা দেবেন না।”
তা বলে কি মোহন-ইস্ট শিবিরে বারুদ ঠাসা নেই? আলবাত আছে। কয়েকটা সামান্য কার পার্কিং স্টিকার দেওয়া নিয়েই দুই ক্লাব কর্তৃপক্ষের ঝামেলা পৌঁছে গিয়েছে পুলিশের ডিজি পর্যায়ে। ফেসবুকে রাজকুমার গুহ নামে এক ব্যক্তি পোস্ট করেছিলেন, “মাঠে আসুন বোমা, লাঠি, ছুরি নিয়ে। বদলা নিতে হবে আগের ডার্বির।” মোহন-কর্তাদের অভিযোগ পেয়ে তাঁকে দিল্লি থেকে গ্রেফতার করে এনেছে পুলিশ। তাতেও অবশ্য নেট-যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। হাঙ্গামার কথা আর কেউ না বললেও দু’পক্ষের সমর্থকরাই পাল্লা দিয়ে ক্ষোভ-রাগ উপচে দিচ্ছেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। ফুটছে ফ্যান ক্লাবগুলো।
তাঁদের শান্ত থাকার বার্তা দেওয়া দুই কোচও যে ভেতরে ভেতরে ফুটছেন, সেটা সাফ বোঝা যাচ্ছে। মর্গ্যান যেমন তাঁর সওয়া দু’বছরের অভ্যাস বদলে ফেলেছেন, যা দেখে তাঁর কোচিং-টিমেরই চক্ষু চড়কগাছ! সাধারণত ম্যাচের আগের দিন প্রথম এগারো ও রিজার্ভ ফুটবলারদের নামের তালিকা ক্লাবে জমা দেন মর্গ্যান। এ বারের ডার্বিতে নামার আগে ওলট-পালট করা নামের একটা তালিকা লিখেছেন। বলে দিয়েছেন, “আমি চাই না কারা খেলবে, সেটা বাজারে বেরিয়ে যাক।” করিমও দেখাতে চাননি তাঁর কোন অস্ত্র কোথায় প্রয়োগ করবেন।
দু’মাস আগের ডার্বি ভেস্তে গিয়েছিল। হরমনজিৎ খাবরার গোলে তখন এগিয়ে ছিল ইস্টবেঙ্গল। এ বার কী হবে? ডার্বির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা দু’টি নাম, হোসে রামিরেজ ব্যারেটো আর ভাইচুং ভুটিয়া সামান্য এগিয়ে রাখছেন মোহনবাগানকে। সেটা ওডাফা-টোলগের প্রতিভার জন্যই। ব্যারেটো বলছেন, “ডার্বির ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। তবে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জোরে বাগান মনে হচ্ছে সামান্য এগিয়ে।” ভাইচুংয়ের মন্তব্য, “মনে হচ্ছে ১-১ হবে।”
ধুন্ধুমার ম্যাচের ফল যা-ই হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠ ফুটবলপ্রেমীর একমাত্র দাবি কিন্তু কলঙ্কমুক্ত নির্ভেজাল ফুটবল উৎসব। কারণ, সেটাকে ফেরানো গিয়েছে খাদের কিনার থেকে। বাসরাস্তার মাঝবরাবর আবার ঝুলছে পেল্লায় পতাকা, ইলিশ-চিংড়ি নিয়ে আবার হুল্লোড়-টিপ্পনি, রকের আড্ডায়, চায়ের দোকানে আবার চড়া গলায় তর্ক। এরই নাম তো ডার্বি! রাত জেগে কেব্ল-টিভিতে দেখা ম্যাঞ্চেস্টার-বার্সেলোনা ম্যাজিকেও ফিকে হয় না যে সবুজ-মেরুন বা লাল-হলুদ, তারই নাম তো ডার্বি।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, ডার্বির ৮৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম মোহন-ইস্ট লড়াইটা ফার্স্ট বয় বনাম লাস্ট বয়ের। লিগ টেবিলের শীর্ষে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান সবার নীচে। কিন্তু তাতে কী আসে-যায়! ফুটবলারদের দেখুন। ওডাফা, টোলগে, চিডি, পেন, মেহতাব, নবি দুই দলের সব তারকা তৈরি। সেই অর্থে কার্ড সমস্যাও নেই, চোট-আঘাত শূন্য শেষ কবে এমন হয়েছে?
দুই শিবিরে আজ রামধনুর রং লেগেছে। রামধনুর সবুজে, যুবভারতীর সবুজে আজ সব কালোর প্রবেশ নিষেধ! |
অন্য ডার্বি |
• এই প্রথম ৪ ফিফা রেফারি।
• সব থেকে দামি টিকিট। ২০০৫০০।
• ১ লক্ষ ১০ হাজারের স্টেডিয়ামে ৭০ হাজার টিকিট।
• জলের বোতল বারণ। মিলবে পাউচ। থাকবে ফুড স্টল।
• গ্যালারিতে সাদা পোশাকের পুলিশ, সিসিটিভি। |
মাঠে আসুন। কিন্তু দোহাই কেউ স্ট্রেচারে বা অ্যাম্বুল্যান্সে ফিরবেন না।
ট্রেভর জেমস মর্গ্যান |
আপনাদের সমর্থন দরকার। কিন্তু প্ররোচনায় পা দেবেন না।
করিম বেঞ্চারিফা |
|