জমছে পলি, কচুরিপানা
সংস্কার বন্ধ থাকায় মজে যাচ্ছে ইছামতী
কদিকে পূর্ণাঙ্গ নদী সংস্কারের অভাবে ক্রমশ মজে যাচ্ছে ইছামতী নদী, অন্য দিকে কচুরিপানাতে দীর্ঘদিন ধরে ভরে রয়েছে ইছামতীর বুক। নদীর বুকে কচুরিপানা শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মাছ মরে যাচ্ছে। মৎস্যজীবীরা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। ছড়াচ্ছে দূষণ। বেড়েছে মশার উপদ্রব। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে নদী থেকে কচুরিপানা তোলার অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে দাবি জানানো হলেও প্রশাসন অনুমতি দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। ফলে কচুরিপানা তোলা যাচ্ছে না।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নদিয়ার মাজদিয়ার পাবাখালি (ইছামতির উৎসমুখ) থেকে উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার কালাঞ্চি সেতু পর্যন্ত ইছামতির দূরত্ব প্রায় ১০৫ কিলোমিটার। বনগাঁ মহকুমার দত্তফুলিয়া থেকে কালাঞ্চি সেতু পর্যন্ত দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। পাবাখালি থেকে কালাঞ্চি সেতু পর্যন্ত নদী কোথাও সম্পূর্ণ মজে গিয়েছে, কোথাও বা হাঁটুজল। আবার কোথাও নদী মুখ ঢেকেছে কচুরিপানায়।
বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন দত্ত বলেন, “অতীতে একশো দিনের কাজ প্রকল্পের মাধ্যমে নদী থেকে কচুরিপানা তোলা হত। এ বার জেলা প্রশাসন সেই অনুমতি দিচ্ছে না বলে সমস্যা দেখা দিয়েছে।” বনগাঁ মহকুমা শাসক অভিজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “একশো দিনের কাজ প্রকল্পে কচুরিপানা তোলা এখন বন্ধ রয়েছে।” কেন? তার উত্তর তিনি দিতে পারেননি। জেলা প্রশাসনের একাংশ সূত্রে জানা গিয়েছে, অতীতে দেখা গিয়েছে এই প্রকল্পে কচুরিপানা তোলার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়। তা ছাড়া কচুরিপানা তুলে স্থায়ী কোনও সম্পদ তৈরি হয় না। পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি নিজস্ব ফান্ড থেকে কচুরিপানা তুলতে পারে। কিন্তু পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির নিজস্ব আয় খুবই কম। ফলে, সম্ভব নয়। কচুরিপানা থাকায় জল পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সৌমেনবাবু বলেন, “রানি মাছ মরে যাচ্ছে। মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে না-পেরে কর্মহীন হচ্ছেন।”

বনগাঁয় ইছামতীর বর্তমান চেহারা। ছবি: পার্থসারথি নন্দী।
নদীপাড়ের বাসিন্দারা জানালেন, মশার উপদ্রবে ঘরে টেকা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। মৎস্যজীবীদের অনেকে জাল নৌকো তুলে রেখেছেন। শুধুমাত্র বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতি এলাকাতেই মৎস্যজীবী রয়েছেন ৮ হাজার পরিবার। কচুরিপানার পাশাপাশি মৎস্যজীবীদের একাংশ বে-আইনি ভাবে ভেচাল, কোমড় ফেলে মাছ ধরবার জন্য নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল অবশ্য কচুরিপানা তোলার বিষয়ে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সঙ্গে কথা বলবেন।
এ তো গেল কচুরিপানার সমস্যা। সংস্কার না-হওয়ার ফলে উৎসমুখ থেকে ক্রমশ নদী হারিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। কমিটির সম্পাদক সুভাষ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “পাবাখালিতে উৎসমুখ থেকে প্রথমে নদীর আড়াই কিলোমিটার মজে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তা ৯ কিলোমিটার হয়ে যায়। বর্তমানে উৎসমুখ থেকে ফতেপুর পর্যন্ত সাড়ে ১৯ কিলোমিটার নদীপথ সম্পূর্ণ মজে গিয়েছে। বিষয়টি রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানানো হয়েছে।” সুুভাষবাবুর দাবি, শীঘ্রই রাজীববাবু ওই অংশ পরিদর্শনে আসবেন বলে জানিয়েছেন। তার পর নদী সংস্কারের দাবি জানিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রককে চিঠি দেবেন। সুভাষবাবুর কথায়, “উৎসমুখ সংস্কার ছাড়া নদী বাঁচানো সম্ভব নয়।”
বাস্তবে ইছামতীর আজ আর কোনও উৎসমুখই নেই! খাতায়-কলমে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের পাবাখালিতে মাথাভাঙা নদী থেকে ইছামতীর সৃষ্টি। কিন্তু বর্তমানে ওই জায়গায় গেলেই দেখা যায়, মাথাভাঙা থেকে ইছামতী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার নদীপথে চরা পড়ে গিয়েছে। সেখানে জোর কদমে চলছে চাষবাস। তৈরি হয়েছে মাটির রাস্তা। চলাচল করছে যানবাহন।
কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক তৃণমূলের সুশীল বিশ্বাস বলেন, “উৎসমুখ সংস্কার করবার ক্ষেত্রে রেল দফতরের আপত্তি রয়েছে। মাটি কেটে নদী সংস্কার করলে নাকি রেলের যে সেতুটি রয়েছে তা দুর্বল হয়ে যাবে। বিধানসভায় বিষয়টি তুলব।” তাঁর দাবি, মানস ভুঁইয়া সেচমন্ত্রী থাকাকালীন, সেচ দফতর টাকা অনুমোদন করেছিল সংস্কারের জন্য। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে নদী সংস্কার করতে চেয়ে সেচ দফতরের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
গত ৮ বছরে উত্তর ২৪ পরগনার তেঁতুলিয়া সেতু থেকে কালাঞ্চি সেতু পর্যন্ত এবং বর্ণবেড়িয়া থেকে কালাঞ্চি সেতু পর্যন্ত দু’দফায় নদী থেকে পলি তোলা হয়েছে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে। সাময়িক ভাবে গভীরতা বেড়েছিল। স্রোতও ছিল। কিন্তু ফের নোনা জলের সঙ্গে পলি ঢুকে নাব্যতা কমে গিয়েছে। অভিযোগ উঠেছিল, নদীর পলি পাড়ে রাখা হয়েছিল এবং তা ফের বৃষ্টিতে নদীতে চলে যায়। দুই জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের কাছে তাই এখন এই নদী আতঙ্কের। ফি বছর অল্প বৃষ্টি বা অতি বৃষ্টিতে নদীর জল ঢুকে ব্যাপক কৃষি কাজের ক্ষতি করে। বহু মানুষ গৃহছাড়া হন। আন্তর্জাতিক এই নদীটি (ভারত-বাংলাদেশ) যৌথ দেশের নদী কমিশনের প্রতিনিধিরা ঘুরে দেখেছেন। দু’দেশের জলসম্পদ মন্ত্রীরাও পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবে নদী সংস্কার হলেও পূর্ণাঙ্গ নদী সংস্কার হয়নি। বাসিন্দারা এখন বাঁচার আশায় ওই দাবি তুলেছেন।
নদিয়ার জেলাশাসক অভিনব চন্দ্রা অবশ্য বলেন, “একশো দিনের কাজ প্রকল্পের মাধ্যমে ইছামতী সংস্কারের আবেদন করা হয়েছিল। কেন্দ্র অনুমতিও দিয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু করা হবে। কচুরিপানাও তোলা হবে।”
যদিও এতে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার সম্ভব কি না, তা নিয়ে সংশয়ে বাসিন্দারা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.