দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীরাম কলেজ অব কমার্স-এ কলেজ-ছাত্রদের সামনে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা এবং প্রয়াগের মহাকুম্ভে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের মোদী-বন্দনার মধ্যে সংযোগ আছে, এমন কথা হলফ করিয়া বলা শক্ত। তবে দুইটি ঘটনাই একটি রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করিতে পারে। তাহা হইল বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে মোদীর উত্থান। দিল্লির নাগরিক যুব সমাজকে আপন বীক্ষা ও কর্মসূচিতে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া রাখার পদক্ষেপটি যদি মোদীর নিজের হয়, সংঘ পরিবারের তরফে তাঁহাকে অনুমোদনের শংসাপত্রটি তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরসংঘচালকের। মোদী যে ক্রমেই বিজেপির জাতীয় নেতৃত্বের অবিকল্প দাবিদার হইয়া উঠিতেছেন, তাহাতে সংশয় নাই। তবে সাংগঠনিক নেতৃত্ব নয়, তিনি হাসিল করিতে উদ্গ্রীব দেশের শীর্ষ প্রশাসনিক আধিকারিকের পদ। গুজরাতের প্রাদেশিক পরিসর অতিক্রম করিয়া জাতীয় রাজনীতির ব্যাপকতর ও বৃহত্তর পরিসরে পদচারণার সেই অভিপ্রায়টিই এতদ্দ্বারা পূর্ণ করার প্রয়াস।
নাগরিক যুব সমাজ যে নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নের বার্তায় মজিয়াছে, তাহা স্পষ্ট। মূলত দেশের মধ্য শ্রেণির এই তরুণ প্রজন্ম স্বভাবতই ইউপিএ-২ সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা, দ্বিধাগ্রস্ততা এবং দুর্নীতিপরায়ণতার বিকল্প অন্বেষণ করিতেছেন। মোদীর ধারাবাহিক মুখ্যমন্ত্রিত্বে গুজরাতের চমকপ্রদ অগ্রগতি ও উন্নয়ন, সেখানকার অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন অবশিষ্ট ভারতের তরুণদের আকৃষ্ট করিবে, ইহা স্বাভাবিক। মোদী নিজেও তাঁহার অতীতকে প্রায় অস্বীকার করিয়া ভবিষ্যতের অঙ্গীকার লইয়া হাজির। ছাত্রযুবসমাজকে তিনি হতাশার বদলে উজ্জ্বল আশাবাদের কথা শুনাইতেছেন। কিন্তু যতই তিনি ভবিষ্যতের কথা বলুন, তাঁহার অতীত খুব সহজে তাঁহার পিছু ছাড়িবে বলিয়া মনে হয় না। সেই অতীত সম্পর্কে অনুতাপহীন, প্রায়শ্চিত্তবিমুখ মনোভাবের মধ্যে অনেকেই ঔদ্ধত্য দেখিতে পান। গুজরাত নির্বাচনে বিজয়ী হইবার পরে তিনি সূক্ষ্ম ভাবে আপন ‘ভুল’-এর কথা উচ্চারণ করিয়াছেন বটে, কিন্তু এখনও অবধি তাহা নিতান্তই ব্যতিক্রমী আচরণ। তাঁহার স্বভাবগত অসহিষ্ণুতা প্রশাসন পরিচালনার কাজেও দলীয় সহকর্মী ও বরিষ্ঠ আমলাদের হয়তো তাঁহার প্রতি সন্দিগ্ধ করিয়া তোলে। গুজরাতি অস্মিতার পরিসরে ইহার যে কার্যকারিতাই থাক, জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরে ইহা একটি সীমাবদ্ধতা বলিয়াই গণ্য হইবে। বস্তুত আরএসএসের সঙ্গেও মোদীর সম্পর্ককেও মসৃণ বলিলে ভুল হইবে। এ ক্ষেত্রে যে দ্বিপাক্ষিক টানাপড়েন, তাহার মূলেও রহিয়াছে মোদীর ব্যক্তিগত আচরণ ও কাজের ধারা, যাহা সর্বদা ঠিক গণতান্ত্রিক বলিয়া প্রতিভাত হয় না।
সংঘ পরিবারের অন্য শরিকরা (যেমন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সন্ত সমাজ, বজরঙ দল) মোদীর ব্যাপারে যতটা উৎসাহী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সম্ভবত ততটা নয়। তবু যে মোহন ভাগবত তাঁহার গুরুত্বের কথা তুলিতেছেন, তাহার কারণ, অনুমান করা যায়, বিজেপির অভ্যন্তরীণ চাপ। এই চাপের বিপরীতে এনডিএ-র শরিক সংযুক্ত জনতা দল তথা নীতীশ কুমারদের তীব্র মোদী-বিরোধিতার সমস্যাটিও রহিয়াছে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর মধ্যে যে সর্বদলগ্রাহ্যতা ছিল, সকলকে লইয়া চলার যে উদার মানসিকতা ছিল তাঁহার চরিত্রলক্ষণ, মোদী অনেকাংশে তাহার বিপরীত মেরুতে। তাই তিনি আরএসএসকে শাসনপ্রণালী হইতে শতহস্ত দূরে রাখার চেষ্টা করিলেও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা সেটাকে তাঁহার ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ গণ্য করিবেন কি না, বলা কঠিন। বরং সংঘ পরিবার অনুমোদিত এই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর পক্ষে ও বিপক্ষে ভোটদাতাদের মেরুকরণ সুনিশ্চিত করিবে। মেরুকরণের নমুনা ইতিমধ্যেই শ্রীরাম কলেজের বাহিরে সমবেত বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারীর প্রতিবাদে মিলিয়াছে। এক দিকে হিন্দুত্ব, অন্য দিকে উন্নয়নমুখী ভারতের স্বপ্নের মিশ্রণ মোদীকে কতটা আগাইয়া রাখিবে, ভবিষ্যৎই বলিতে পারে। তবে গুজরাতের হিন্দুহৃদয়সম্রাট হইতে রাষ্ট্রের কর্ণধারত্বে উত্তরণের পথটি যে কুসুমাস্তীর্ণ নয়, এই প্রাথমিক উদ্যোগপর্ব হইতেই নরেন্দ্র মোদী বোধহয় তাহা টের পাইতে শুরু করিয়াছেন। |