মেরেকেটে হাতে রয়েছে মাসখানেক। এ বছর মার্চেই বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯ কার্যকর করার ঘোষণা করেছে কেন্দ্র সরকার। অথচ, আইন কার্যকর হওয়ার আগে আবশ্যিক শর্তগুলিই এখনও অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে রাজ্যের বহু স্কুলে। পিছিয়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গও।
শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) অনুযায়ী, ২০১৩ সালের মার্চের মধ্যেই প্রতিটি রাজ্যকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি এক কিলোমিটারে একটি করে প্রাথমিক স্কুল ও ২ কিলোমিটারে একটি করে উচ্চ প্রাথমিক স্কুল থাকতে হবে। প্রতিটি স্কুলে ক্লাস অনুযায়ী ক্লাসরুম, প্রাথমিক স্কুলে পাঁচিল থাকা বাধ্যতামূলক। ছেলে ও মেয়েদের আলাদা শৌচাগার থাকার কথাও রয়েছে এই আইনে। ৩০ জন ছাত্র পিছু ১ জন করে শিক্ষক ও ১৫০ জন পড়ুয়া রয়েছে এমন স্কুলে ন্যূনতম পাঁচ জন শিক্ষক থাকা ও ১ জন প্রধান শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক।
উত্তরবঙ্গের ছ’টি জেলায় প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষা (২০১২) করেছিল প্রতীচী। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এই শর্তগুলির অধিকাংশই এখনও সম্পূর্ণ নয়। গোটা উত্তরবঙ্গে ৩ শতাংশ স্কুল চলছে কোনও রকম ক্লাসরুম ছাড়াই। অনেক শিক্ষকই গাছতলায় ক্লাস করাতে বাধ্য হচ্ছেন। ক্লাসরুম না থাকায় রোদে জলে বারবারই ব্যাহত হচ্ছে পড়াশোনা। তার মধ্যে দার্জিলিং জেলায় ক্লাসরুম ছাড়াই চলছে প্রায় ৪ শতাংশ স্কুল। গোটা উত্তরবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় ক্লাসরুম ৪৪ শতাংশ কম। শহর অঞ্চলে অপর্যাপ্ত ক্লাসরুম প্রায় ২০ শতাংশ।
সব প্রাথমিক স্কুলে ছেলে-মেয়েদের আলাদা শৌচাগার থাকা বাধ্যতামূলক। ২০১১-১২-র ডাইস রিপোর্ট অনুযায়ী অনেক স্কুলে শৌচাগার তৈরি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা অব্যবহৃতই থেকে গিয়েছে। প্রতীচীর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দার্জিলিঙেই ৬৮ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের আলাদা শৌচাগার নেই। ৭০ শতাংশ স্কুল চলছে মেয়েদের শৌচাগার ছাড়াই। উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার ব্লকের শিক্ষক আজহার উল ইসলামও বলেন, “আমার জেলাতেও সব স্কুলে এখনও শৌচাগার করা যায়নি। শৌচাগারের অভাবে পরিচ্ছন্নতা বোধও গড়ে তোলা যাচ্ছে না।” সর্বশিক্ষা দফতর সূত্রে দাবি, পরিকাঠামোর এখনও কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে ৩১ মার্চের মধ্যে সমস্যাগুলি মিটিয়ে ফেলার।
শিক্ষক ছাত্র অনুপাতেও রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। বিশেষ করে দার্জিলিঙে দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত শিক্ষকই রয়েছেন ১৫২৩ জন। অথচ শতাধিক স্কুলে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১ জন। প্রতীচীর সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উত্তরবঙ্গের ১৬ শতাংশ স্কুলেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। সব থেকে খারাপ অবস্থা দক্ষিণ দিনাজপুরের। ২০ শতাংশ স্কুলেই পড়ুয়ার প্রয়োজনের অনুপাতে শিক্ষক কম। পড়ুয়া অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সামঞ্জস্যের অভাব দেখা যাচ্ছে। শিলিগুড়িতে একটি স্কুলে যেখানে কোনও পড়ুয়াই নেই, সেখানে শিক্ষক রয়েছেন দু’জন। অন্য দিকে, পাশেই আরএকটি স্কুলে ৮৯৯ জন পড়ুয়ার জন্য রয়েছেন মাত্র পাঁচ জন শিক্ষক। দার্জিলিঙে প্রায় ৪৩ শতাংশ স্কুলেই ক্লাসের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম। আজহারবাবুও জানান, ক্লাসভিত্তিক শিক্ষকের অভাব খুব বড় সমস্যা। মালদহ, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুরে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক-অশিক্ষক মিলিয়ে ১০টির মধ্যে ৬টি পদই খালি। সমস্যা স্বীকার করে সর্বশিক্ষা অভিযান দফতর সূত্রে বলা হয়েছে, সারা রাজ্যে শিক্ষক পড়ুয়ার গড় অনুপাত শিক্ষার অধিকার আইনের শর্ত পূরণ করছে ঠিকই। কিন্তু স্কুলভিত্তিক ভাবে শিক্ষক পড়ুয়া অনুপাতে অনেক ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্য নেই। এই অনুপাতের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করতে হবে। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডি পূর্বচক্রের এক শিক্ষক বিভাস দাস বলেন, “সরকারি তরফে নজরদারির অভাব রয়েছে। সরকার ও প্রশাসনের উদ্যোগ ছাড়া এই অবস্থা থেকে বেরোনো সম্ভব নয়।”
পরিকাঠামোর অভাব তো রয়েইছে। কিন্ত তার মধ্যেই যেটুকু পড়াশোনা চলছে, সংশয় তৈরি হচ্ছে তার মান নিয়েও। বেশিরভাগ অভিভাবকদেরই বক্তব্য, উন্নত মানের শিক্ষা পাচ্ছে না তাঁদের শিশুরা। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষেত্রে চতুর্থ শ্রেণির দশজনে একজন অঙ্কে শূন্য পাচ্ছে। স্কুলের ফলেও দেখা যাচ্ছে, চতুর্থ শ্রেণিতেও প্রায় ৬০ শতাংশ পড়ুয়া অঙ্কে ‘সন্তোষজনক নম্বর’ (৩৪) তুলতে পারছে না। বিশেষ করে, আদিবাসী ও উর্দুভাষী মুসলিম পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে ভাষাও একটা বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আজহারবাবুর কথায়, “আমাদের এখানে বেশিরভাগ পড়ুয়াই উর্দু বা সূর্যপুরী ভাষায় কথা বলে। অথচ, এখানে কোনও শিক্ষকই এই ভাষাগুলি বলতে পারেন না। এটাই উন্নত মানের শিক্ষা না দিতে পারার মূল কারণ।” |