অফিসে বসে বুকে-পিঠে ব্যথা শুরু হয়েছিল অতনু দাসের। অম্বল হয়েছে ভেবে সহকর্মীরা প্রথমে অ্যান্টাসিড খাইয়েছিলেন। ব্যথা কমেনি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জ্ঞান হারালেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো গেল না বত্রিশের তরতাজা যুবকটিকে।
দমদমের মন্টু পাল ট্রেনে যেতে যেতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হাসপাতালে আনার আগেই সব শেষ। বয়স মোটে ত্রিশ!
যাদবপুরের বাড়িতে পল্টু সরকারের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে ঘরের বাইরে গিয়েছিলেন নববিবাহিতা স্ত্রী। মিনিট কয়েক বাদে কাপ-প্লেট ভাঙার তুমুল শব্দ। ছুটে এসে দেখেন, স্বামী নিথর। পল্টুবাবু আঠাশও পেরোননি!
তিনটি মৃত্যুর ধরন আলাদা। কিন্তু কারণ একই। ওই তিন জন যুবকই মারা গিয়েছেন হার্ট অ্যাটাকে। এবং তিন জনই উপসর্গহীন হৃদরোগের শিকার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, অল্পবয়সীদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। যার মূল কারণ হিসেবে ধূমপান ও কর্মক্ষেত্রে অত্যধিক চাপের (স্ট্রেস) দিকে আঙুল তুলছেন তাঁদের অনেকে। বহু ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাও অল্প বয়সীদের হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে বলে ওঁদের দাবি। মেয়েরাও বিপদের আওতায় বাইরে নন। বিশেষত কর্মরত তরুণীদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যাবৃদ্ধিকে ‘অতি বিপজ্জনক’ প্রবণতা হিসেবে দেখছেন চিকিৎসকেরা।
হার্ট অ্যাটাক হয় কেন? বিশেষজ্ঞ মহলের ব্যাখ্যা: হৃৎপিণ্ডের ভিতরে তিনটি মূল ধমনী থাকে। সেগুলোই মূলত রক্ত সঞ্চালন করে। তার কোনও একটা কাজ বন্ধ করে দিলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তা অকেজো হতে পারে কী ভাবে?
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ধমনীর ভিতরে ধীরে ধীরে মেদ জমতে থাকলে শেষে রক্তনালীর অভ্যন্তরীণ পথ পুরোপুরি বুজে যায়। হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞ অরুণাংশু গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “ধমনীর ভিতরের প্রাচীরে এন্ডোথেলিয়াম কোষের একটি স্তর থাকে। সেটির তলায় চর্বি জমা হতে থাকে। ওই এন্ডোথেলিয়াল স্তর ফেটে চর্বি রক্তের সংস্পর্শে এলে রক্ত জমাট বেঁধে যায়, সঞ্চালন বন্ধ হয়। এটা হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ।” |
এন্ডোথেলিয়াল স্তর ফাটতে পারে কী ভাবে? হৃদ্রোগ-বিশেষজ্ঞ সত্যজিৎ বসুর ব্যাখ্যা, “রক্ত খুব উচ্চচাপে দীর্ঘ সময় ধরে ধমনী দিয়ে যেতে থাকলে এন্ডোথেলিয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক জায়গা ক্ষয়ে যায়।” সত্যজিৎবাবুর মতে, প্রচুর মানসিক চাপ (স্ট্রেস) রয়েছে, এমন কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের রক্তচাপ সাধারণত বেশি থাকে। বেশ কিছু দিন ধরে একটানা স্ট্রেস নেওয়ায় এন্ডোথেলিয়ালে ক্ষয় ধরে। ধূমপানেও এন্ডোথেলিয়াল দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞেরা এ-ও জানাচ্ছেন, বয়স্কদের তুলনায় অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রেই হার্ট অ্যাটাক প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। কেন?
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অশোক পরিদা বলছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ডে তিনটি মূল ধমনীর পাশাপাশি আরও কয়েকটি ছোট ছোট ধমনী তৈরি হয়। ফলে মূল ধমনী বন্ধ হয়ে গেলেও ছোটগুলো দিয়ে সঞ্চালন চলতে থাকে। কিন্তু তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের ক্ষেত্রে তা সাধারণত হয় না। ফলে মূল ধমনী বন্ধ হলে সঞ্চালনের বিকল্প পথ বিশেষ থাকে না। অস্বাভাবিক উচ্চ রক্তচাপ, ব্লাড সুগার, ট্রাইগ্লিসারাইড ও স্থূলতা দেখা দিলে অবিলম্বে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অশোকবাবু।
পাশাপাশি হৃদরোগের উপসর্গকে মামুলি গ্যাস-অম্বল হিসেবে ধরে নেওয়াটা মারাত্মক হতে পারে। যেমনটা হয়েছিল অতনুবাবুর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, অম্বল ভেবে মুঠো-মুঠো অ্যান্টাসিড খাওয়া উচিত নয়। “দীর্ঘ দিন ধরে গ্যাস-অম্বল হচ্ছে দেখে অনেক ডাক্তার অ্যান্টাসিড খেতে বলেন। সেটাও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে।” মন্তব্য সত্যজিৎবাবুর। চিকিৎসকদের হুঁশিয়ারি, এই জাতীয় ওষুধ দীর্ঘ দিন ধরে খেলে পাকস্থলীতে নির্গত হরমোনের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হয়। টিউমারও হতে পারে।
তা হলে বিপদ এড়ানোর উপায় কী? হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: বুকে যন্ত্রণার মতো কোনও উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞের চেম্বারে পৌঁছতে হবে। যত দ্রুত চিকিৎসা হবে, সেরে ওঠার সম্ভাবনা তত বাড়বে। আর যে সব পেশায় অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকতে হয়, সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার উপকরণ হিসেবে ডাক্তারের পরামর্শমাফিক এমন কিছু ওষুধ হাতের কাছে রাখা জরুরি, যা ধমনীতে জমাট বাঁধা রক্ত দ্রুত পাতলা করে দিতে পারে। |