|
|
|
|
বিভ্রান্ত হয়েই মুখ্যমন্ত্রীর রোষে পুলিশ |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
সব ভিআইপি যে ভাবে বেরোন, ভাবা হয়েছিল তিনিও বইমেলা থেকে সেই ‘রুট’ ধরেই বেরোবেন। প্রস্তুতিও ছিল সে রকম।
কিন্তু তিনি যে অন্য রাস্তা ধরবেন, পুলিশকে তা জানাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কারণেই বুধবার রাতে বইমেলায় তাঁর গাড়ি আনতে দেরি হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের অফিসারেরা। আর তাতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন মুখ্যমন্ত্রী। জনসমক্ষে তাঁর রোষের মুখে পড়েন নিরাপত্তারক্ষীরা।
মেজাজ হারিয়ে মমতা তাঁর নিরাপত্তারক্ষীদের ‘চাবকানো উচিত’ বলে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করেছেন। যা নিয়ে জোর বিতর্কও দানা বেঁধেছে। কলকাতা পুলিশ-কর্তৃপক্ষের সূত্রে ঘটনাটিকে ‘বোঝাপড়ায় সামান্য অভাব’ হিসেবে অভিহিত করা হলেও কর্তারা কেউ প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা জানিয়েছিলেন, পরে তিনি এ নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার সারা দিনে আর তিনি ফোন ধরেননি।
অতীতে বিভিন্ন মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা-দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসারদের অনেকে অবশ্য একান্ত আলাপচারিতায় ঘটনাটিকে বিপজ্জনক মনে করছেন। তাঁদের আক্ষেপ, মমতা বরাবরই পুলিশের সুরক্ষা-নীতির তোয়াক্কা না-করে জনসংযোগকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর কাজকর্মের সময়সূচি সম্পর্কেও পুলিশ সব সময়ে ঠিকঠাক অবহিত থাকে না। ফলে বিভ্রান্তি ও বিপত্তি হয়। বইমেলার ঘটনা তারই পরিণতি। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর জন্য নির্ধারিত সুরক্ষা-বন্দোবস্ত পুরোপুরি মেনে না-চললে ভবিষ্যতে অনেক বড় কিছু ঘটে যেতে পারে বলে এই মহলের আশঙ্কা।
বুধবার ঠিক কী হয়েছিল? |
|
|
অপমানেও দায়িত্বে অবিচল কুসুমকুমার দ্বিবেদী। (বাঁ দিকে) বুধবার রাতে যখন
তাঁকে ধমক দিয়ে হাঁটা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবারও মমতার ছায়াসঙ্গী তিনিই। |
|
রাত ৭টা ৫৭ মিনিটে মুখ্যমন্ত্রী বইমেলায় ঢুকেছিলেন। পুলিশ-সূত্রের খবর, চার নম্বর গেট দিয়ে তাঁর গাড়ি মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। এসবিআই অডিটোরিয়ামের কাছে মমতা গাড়ি থেকে নেমে ঢুকে যান পশ্চিমবঙ্গ স্টলে। তাঁর গাড়ি রাখা হয় অডিটোরিয়াম সংলগ্ন পার্কিং প্লেসে, যেটির অবস্থান মেলা প্রাঙ্গণের উত্তর দিকে। মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ স্টল থেকে বেরিয়ে ‘জাগো বাংলা’ স্টল ও গিল্ডের অফিস ঘুরে চলে যান কলকাতা পুলিশের স্টলে। সেটা মেলার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে। তার লাগোয়া এক নম্বর গেট। মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির চালক ও নিরাপত্তাকর্মীদের ধারণা ছিল, মেলা ছাড়ার সময়ে অন্যান্য ভিআইপি’র মতো মুখ্যমন্ত্রীও অডিটোরিয়ামের কাছে ফিরে গিয়ে সেখান থেকেই গাড়িতে উঠে বেরোবেন। সেই মতো চালক ও রক্ষীরা তৈরি ছিলেন। কলকাতা পুলিশের স্টল থেকে অডিটোরিয়ামে ফেরার পথে নিরাপত্তা-বলয়ও তৈরি হয়েছিল।
কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে অন্য রকম, যার ফলেই বিপত্তি। কী রকম?
পুলিশ-সূত্রের ব্যাখ্যা, কলকাতা পুলিশের স্টল থেকে মুখ্যমন্ত্রী বেরিয়ে পড়েন ৮টা ১২ মিনিটে। কিন্তু এর পরে তিনি সটান উল্টো রাস্তা ধরেন। উত্তরে এসবিআই অডিটোরিয়ামের দিকে যাওয়ার বদলে হনহনিয়ে হাঁটা লাগান দক্ষিণ প্রান্তের এক নম্বর গেটের দিকে! রক্ষীরা হতভম্ব হয়ে পড়েন। ওই পথে যথেষ্ট পুলিশি ব্যবস্থাও ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী এক নম্বর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন দেখে রক্ষীরা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গাড়ি তড়িঘড়ি উত্তর প্রান্তের চার নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে আইটিসি হোটেলের পিছনের পথ ধরে (একমুখী রাস্তার উল্টো মুখে) রওনা হয় এক নম্বর গেটের দিকে। মুখ্যমন্ত্রীকে তুলতে।
কিন্তু লোকে লোকারণ্য সেই ‘ওয়ান ওয়ে’ রাস্তার বিপরীত মুখে গাড়ির গতি স্বাভাবিক ভাবেই শ্লথ হয়ে পড়েছিল বলে পুলিশের দাবি। গাড়ি গিয়ে যখন এক নম্বর গেটের সামনে দাঁড়ায়, মুখ্যমন্ত্রী তার ক’মিনিট আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন। এবং গাড়ি না-দেখে অধৈর্য হয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর রাগ গিয়ে পড়ে নিরাপত্তারক্ষীদের উপরে। তাঁদের তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে (চাবকানো উচিত, ইত্যাদি) তিনি হনহন করে হ্যালডেন সরণি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে যান। সেখানে তাঁর কাছে গাড়ি পৌঁছায় ৮টা ১৯ মিনিট নাগাদ। ওই সময়ে বইমেলায় ডিউটিতে থাকা এক পুলিশ-কর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী কোথা দিয়ে বেরোবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি পৌঁছাতে মিনিট ছয়েক দেরি হয়েছে। ভিড়ে ঠাসা বইমেলার বাইরের রাস্তা দিয়ে উল্টো মুখে গাড়ি কী ভাবে যে ওঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, শুধু আমরাই জানি।”
তা হলে মেলার ভিতর দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া হল না কেন? |
|
পুলিশ-কর্তাদের ব্যাখ্যা, মুখ্যমন্ত্রী আচমকা অন্য পথ ধরায় অত পরিকল্পনার সময় মেলেনি। খবর পাওয়ামাত্র চার নম্বর গেট দিয়ে গাড়ি বার করে দেওয়া হয়। তা ছাড়া এমনিতেই বইমেলা চত্বরের ওই প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্য দিয়ে গাড়ি উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে যাওয়া সহজ হতো না বলে অফিসারদের দাবি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলেছেন যিনি, সেই অরবিন্দ মালিওয়াল এ দিন বলেন, “ভিআইপি স্বয়ং গাড়িতে থাকলে অন্য কথা। খালি গাড়ি ভিড় ঠেলে নিয়ে যাওয়া কঠিন। লোকে সহজে রাস্তা ছাড়তে চায় না।”
ঘটনা হল, মুখ্যমন্ত্রীর মতো ভিভিআইপি’র গতিবিধি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আগমন-প্রস্থানের বিস্তারিত সময়সূচি পুলিশের আগাম নখদর্পণে থাকার কথা। মমতার ক্ষেত্রে তা সব সময়ে হয় না বলে পুলিশ-কর্তাদের একাংশের আক্ষেপ। তাঁদের দাবি, এই নিয়ম মানা হলে বুধবারের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো যেত। পুলিশ-কর্তাদের একাংশ এ-ও বলছেন, মমতা রেলমন্ত্রী বা বিরোধী নেত্রী থাকাকালীনও বারবার নিরাপত্তার নিয়ম ভেঙেছেন। তাঁর সুরক্ষা-দায়িত্ব নিয়ে তৎকালীন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে একাধিক বার চাপান-উতোর হয়েছে। বাম জমানায় রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা নিতে বারবার নারাজ হয়েছেন মমতা। কখনও তাঁর গাড়িতে রাজ্যের পুলিশ অফিসারদের ঠাঁই হতো না। রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে রাজ্য তাঁকে ‘জেড প্লাস’ সুরক্ষা দিতে চাইলে তা নিয়েও সমস্যা হয়েছে। মমতা চেয়েছিলেন, তাঁর নিরাপত্তার ভার থাকুক রেলরক্ষী বাহিনী (আরপিএফ)-র হাতে। এ দিকে রাজ্য পুলিশও হাজির থাকত। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব কে নেবে, তা নিয়ে দু’তরফে বিস্তর টানাপোড়েন চলেছে একটা সময় জুড়ে।
এবং মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও সুরক্ষা-ব্যাকরণ না-মানার প্রবণতা মমতার মধ্যে রয়ে গিয়েছে বলে পুলিশ-কর্তাদের একাংশের অনুযোগ। এখনও তিনি মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি ব্যবহার করেন না, ঘোরেন কালো স্যান্ট্রো চেপে। গোড়ায় লালবাজার কন্ট্রোল হামেশা তাঁর গতিবিধির খবর পেত না। এখন সমস্যাটা কিছুটা কাটলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা-অফিসারেরা মুখ্যমন্ত্রীর গতিবিধি সম্পর্কে অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছেন। ফলে পুলিশকে বিস্তর ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে।
যেমন হয়েছে বুধবার। এমনকী, বৃহস্পতিবারও। এ দিন সওয়া চারটে নাগাদ মহাকরণ থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী রাজভবনে যান। মহাকরণের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে গিয়েছিলেন, “রাজভবনে যাচ্ছি। এক-দেড় ঘণ্টা থাকব।” কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি রাজভবন ছেড়ে বেরিয়ে আচমকা নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের দিকে ঘুরে যায়। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী রাজভবনে যাবেন, এ খবর আমাদের কাছে আগে থেকে ছিল। জানতাম না, উনি ইন্ডোরে যাবেন।” পরে পুলিশ জেনেছে, ইন্ডোরে সরকারি আয়োজনে ‘ফুড ফেস্টিভ্যাল’ চলছে। তা দেখতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশকে আগাম জানানো হয়নি।
এই সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশ-কর্তারা কি কখনও কথা বলেছেন? তেমন কোনও খবর নেই। বরং প্রশ্নটির জবাবে বড়দিনের আগের রাতে সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রাল চত্বরে মোতায়েন এক পুলিশ-কর্তার মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। “ঘাড়ে একাধিক মাথা থাকলে মুখ্যমন্ত্রীকে সময়সূচি জিজ্ঞাসা করতাম!” বলেছিলেন তিনি।
তবে বুধবার বইমেলায় মমতার মেজাজ হারানোর পিছনে আর একটা কারণও দেখছেন পুলিশ-কর্তাদের কেউ কেউ। ওঁরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী বইমেলায় ঢোকা ইস্তক উৎসুক জনতা তাঁর পিছনে হামলে পড়েছিল। হাত বা শাড়ির আঁচলেও টান পড়ছিল। ‘‘এক নম্বর গেটের সামনে তো হুড়োহুড়িতে এক জন সটান মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন! এই ডামাডোলে ওঁর মেজাজ খারাপ হতেই পারে।” জানাচ্ছেন এক অফিসার। পুলিশ কেন ডামাডোল সামলাতে পারল না?
লালবাজারের কর্তাদের অনেকের বক্তব্য, এ ক্ষেত্রে জনতাকে বাধা দিলেও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ‘সুখকর’ হতো না। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মানুষের মধ্যে থাকাই পছন্দ করেন বেশি!
অগত্যা পুলিশ নিরুপায়। “এ যেন শাঁখের করাত। ডাইনে গেলে বিপদ। বাঁয়ে গেলেও। কী যে করব, বুঝতে পারছি না!”— অসহায় মন্তব্য এক অফিসারের। |
|
|
|
|
|