বিনোদন গাঁয়ের পাতেও
ফ্রায়েড রাইসের ভোজবাজি

ছিল সাদা কাগজ পাতা টেবিলে সার-সার কলাপাতা, হয়ে গেল বুফে।
ছিল কোমরে গামছা বাঁধা পাড়ার ছেলেরা, হল গলায় টাই ঝোলানো কেটারিংয়ের লোক।
ছিল রাধাবল্লভি-ছোলার ডাল....
শহরে তো আগেই গিয়েছে। মফস্সল ছাপিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরেও এখন পাল্টে যাচ্ছে ভোজবাড়ির মেনু। শুরুতে শুক্ত বা বেগুনির বদলে কাটলেট-ফ্রাই-স্যালাড, শেষ পাতে মিষ্টি দইয়ের বদলে আইসক্রিম। পাল্টাচ্ছে আগাপাশতলা। কোথাও একটু আগে, কোথাও একটু পরে।
তবে সে কিস্সায় ঢোকার আগে এক বার মনে করে নেওয়া ভাল, এ বঙ্গে ভোজবাড়ির পাতের সাবেক চেহারাটা কেমন ছিল?

মা যা ছিলেন
ছাপোষা মধ্যবিত্ত ঘরে প্রথম পাতে নুন-লেবু, শাক, ভাত। তার পরে মুগডাল, আলু বা বেগুন ভাজা বা বেগুনি, ছ্যাঁচড়া (ভাল নাম ‘নবরত্ন’), একটা তরকারি (গরমে এঁচোড় বা আলু-পটল, শীতে কপি), মাছের কালিয়া। যাদের ট্যাঁকের জোর বেশি তাদের বাড়িতে এর সঙ্গে যোগ হবে লুচি বা রাধাবল্লভি, লম্বা করে কাটা বেগুন ভাজা বা বেগুনি, মুগডালের বদলে ছোলার ডাল এবং মাছের বদলে মাংস (কখনও-সখনও দু’টোই)। গৃহকর্তার পকেটে পয়সা এবং নিমন্ত্রিতদের মুরগি সম্পর্কে কুসংস্কার থাকলে খাসির মাংস, নইলে পোলট্রির মুরগি। শেষ পাতে চাটনি, পাঁপড়, দই, মিষ্টি এবং পান।
এই চেহারার কিছুটা অদলবদল হয় জায়গা বিশেষে। যেমন পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে ভাল কাটাপোনা পেতে গেলে বাঁকুড়া বা আসানসোল থেকে আনা ছাড়া গতি নেই। সেখানে তাই বরাবরই মাছের চেয়ে প্রাধান্য পায় মুরগি। ভাগীরথী কাছে থাকায় নদিয়ার তেহট্টে আবার প্রাধান্য পায় ইলিশ। এঁচোড় বা কপির যে মাখা-মাখা তরকারি মাঝমাঠে অবশ্যই থাকতে হবে, বীরভূমে তার ডাকনাম ‘রসা’। সেই সঙ্গে, ময়ূরেশ্বর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় মাছ-ভাতের শেষে পাতে পড়ত ‘মোটা টক’, যা কি না স্বাদে টক-নোনতা। এখন যেমন মাছের বদলে মুরগির চাহিদা বেড়েছে, টকের জায়গা কেড়েছে চাটনি।
সুন্দরবন-সহ দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায়, হাওড়া-হুগলিতেও প্রথম পাতে শুক্তো দেওয়ার চল রয়েছে। ক্যানিং, বাসন্তী, গোসাবায় ডালের বদলে দিব্যি চলে মুড়িঘণ্টও। রাজ্যের অন্য সব জায়গায় যেমন পোনা মাছের কালিয়ার বদলে মাংস দিলে মান বাড়ে, নোনাজল এবং ভেড়ির কল্যাণে সুন্দরবনে বাগদা চিংড়ি বা ভেটকির পাতুড়ি পড়ে পাতে। এ রকম কিছু ছোটখাটো ফারাক বাদে বাকিটা প্রায় এক।
কেটারার আসার আগে তো বটেই, এখনও যে সব বাড়িতে পুরনো দিনের মেজাজ রয়ে গিয়েছে তার বেশির ভাগেই আগের রাত থেকে বসত ভিয়েন। ময়রা এসে মিষ্টি বানাতে শুরু করেন। ছানা আসে বাছাই জায়গা থেকে। ময়ূরেশ্বরে যেমন মুর্শিদাবাদের কান্দি থেকে। উপলক্ষ বিশেষে তৈরি হয় রাজভোগ, কমলাভোগ, ভাজা মিষ্টি, বেনারসী চমচম, ক্রিম চপের মতো এক-এক রকম মিষ্টি। এবং অবশ্যই বোঁদে, অনুষ্ঠান বাড়িতে কাজের ফাঁকে মুড়ি দিয়ে, লুচি দিয়ে খাওয়ার জন্য যার জুড়ি নেই। একেবারে গরিব বাড়িতেই শুধু দোকান থেকে অল্পস্বল্প মিষ্টি কিনে আনার চল ছিল।

মা যা হইয়াছেন
বিয়ের পাত্রপাত্রীদের চার হাত এক করার ‘দায়িত্ব’ যেমন ঘটকদের হাত থেকে ইন্টারনেট সাইটের কাছে চলে গিয়েছে, নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়নের দায়িত্বও এখন আর পাত্রীর ছোটমামার নয়, কেটারারের। মূলত তারাই গাঁয়ে-গঞ্জে ভোজবাড়ির সংজ্ঞাটা বদলে দিচ্ছে। জেলার বড় শহর তো বটেই, ব্লক সদরগুলিতেও এখন তাদেরই রমরমা। কলাপাতা বা শালপাতার থালার জায়গা নিয়েছে থার্মোকলের ডিশ।
কেটারিং বলতে গ্রামবাংলা বোঝে দু’রকম ব্যবস্থার যে কোনও একটি ১) শুধু পরিবেশন ২) রান্না এবং পরিবেশন। প্রথম ক্ষেত্রে যেহেতু চিরচেনা ঠাকুরেরাই রান্না করেন, পদেরও বিশেষ হেরফের হয় না। এই সব ঠাকুর-রাঁধুনিরা চিকেন মাঞ্চুরিয়ান বা চিজ পোলাওয়ের মতো ‘বিদেশি’ পদ রাঁধতে জানেন না। যে সব কেটারিং সংস্থা রেঁধে-বেড়ে খাওয়ায়, তারাই মূলত হরেক অচেনা পদ আমদানি করে গাঁ-গঞ্জের জিভের স্বাদ পাল্টে দিচ্ছে।
এই দ্বিতীয় ধরনের কেটারিংয়ের কল্যাণেই এখন নদিয়ার তেহট্ট বা করিমপুরেও ভাতের পাশাপাশি মেনুতে জায়গা করে নিচ্ছে ফ্রায়েড রাইস। যদিও তার সঙ্গে চিলি চিকেন বা প্রন তন্দুরি এখনও এসে পৌঁছয়নি। আদ্রা-রঘুনাথপুরে মেনুতে দিব্যি ঢুকে পড়েছে বিরিয়ানি। শুরুতে শাক-শুক্তোর বদলে ভেজিটেবল চপ বা ফিশ কাটলেট, লুচি-ছোলার ডালের জায়গায় নান আর পালক পনির। শেষ পাতে দইয়ের বদলে অবশ্যই আইসক্রিম। মিষ্টির তালিকায় বোঁদে বাদ, রসগোল্লার সঙ্গে রকমারি সন্দেশ বা গুলাবজামুন। পানের বদলে প্লাস্টিক পাউচে পানমশলা বা মৌরি-জোয়ান।
বর্ধমান শহরের এক জনপ্রিয় কেটারিং সংস্থার কর্ণধার সত্যজিৎ দত্তের দাবি, “এখন গ্রাম ও শহরের বিয়েবাড়ির মেনু আলাদা করে চেনার উপায় নেই। মানুষ তেল জবজবে মাংস বা মাছের ঝোলের বদলে পছন্দ করছেন বিরিয়ানি, ফিস বাটারফ্লাই, রেশমি পরোটা, নান, চিকেন ভর্তার মতো কম তেলের খাবার। সেই বুঝে আমাদেরও মেনু সাজাতে হচ্ছে।” মফস্সল শহরেও বিয়েবাড়ির উঠোনে থাকছে কয়েকটি ‘ফুড স্টল’। সেখানে যেমন ঢালাও ফুচকা থাকছে, মিলছে পাস্তাও। রুই-কাতলার বদলে মাছের ডিশে চলে এসেছে পারসে, তোপসে, পমফ্রেট, ভেটকি, গোল্ডেন প্রন, মায় চিতল মাছের মুইঠ্যা। আগে-পিছে পিজ পোলাও, চিকেন রেশমি কাবাব, মাটন টিক্কা, পাপড়ি চাট, ফিশ তন্দুরি, কেশর জিলাপি উইথ মালাই। চিকেন মাঞ্চুরিয়ান তো জলভাত!
প্রায়ই শহর-মফস্সল ছাড়িয়ে দূর গ্রামেও ডাক পড়ছে কেটারারের। সুন্দরবন পর্যটনের দৌলতে ক্যানিং অনেক দিন ধরেই কেটারার-নিয়ন্ত্রিত। এখন বাসন্তী-গোসাবাতেও একই চল হচ্ছে। পুরুলিয়ার বলরামপুরে শম্ভুনাথ কুণ্ডুর ছেলের বৌভাতে এলাকারই কেটারার কাটলেট-বিরিয়ানি খাইয়ে এসেছেন। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের ধানাড়া গ্রামে তপনকান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতির অন্নপ্রাশনে মিক্সড ভেজ খাইয়েছে মৌতোড়ের কেটারার। ময়ূরেশ্বরে ডাঙাপাড়ার ফটিকচন্দ্র দে আবার নাতনির অন্নপ্রাশনে সিউড়ি থেকে নামী কেটারার ডেকেছিলেন। নিরামিষ পদে তারা ভেজ মাঞ্চুরিয়ান, ছানার ডালনা, সয়াবিনের কাটলেট, ফুলকপির রোস্ট খাইয়ে গিয়েছে। বর্ধমানে কালনা ১ ব্লকের উপলতি গ্রামের উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বা কালনা ২ ব্লকের পূর্ব সাহাপুর গ্রামের শেরিফ আখতার মণ্ডলও বিয়ের ভোজে নিমন্ত্রিতদের কেটারারের জিম্মায় সঁপে দিয়েছেন। বর্ধমানের হুগলি ঘেঁষা রায়না-জামালপুর বা বাঁকুড়ার কাছাকাছি খণ্ডঘোষে গাঁয়ের বিয়েবাড়িতেও দেখা মিলছে গাঙ্গুরামের দই অথবা ‘আবার খাব’ সন্দেশের।

দেখতে দেখতে সবই পাল্টে যায়...
পাল্টেছে খাইয়েদের পেটের আর মনের সাইজও।
আগে আশি পিস মাছ, আধ বালতি মাংস, চার হাঁড়ি দই, দেড়শো রসগোল্লা যিনি খেতে পারতেন, তাঁকে প্রায় বীরের চোখে দেখা হত। প্রায়ই এই ভোজনবিলাসীদের ঘিরে জমে উঠত বিয়েবাড়ির শোরগোল। আটের দশক থেকে মহিমা হারাতে হারাতে তাঁরা এখন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতোই অবলুপ্তপ্রায়। এখন বিয়েবাড়িতে কেউ খান দশেক রসগোল্লা খেয়ে ফেললেই আশপাশে লোকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। বাড়ির লোক উসখুস। ডায়েট-সচেতন নিমন্ত্রিতদের আকৃষ্ট করতে তাই মেনুতে চমক দিতে হয় কেটারারকে।
চমক থাকছে বাসন-কোসনেও। গেল অগ্রহায়ণেই বর্ধমানের আউশগ্রামে বনসুজাপুরের এক বিয়েবাড়িতে খেতে গিয়ে অভিজিৎ হাজরার চোখ কপালে। দেখেন শালপাতা নয়, ডিশ-প্লেটও নয়, ঝকঝকে কাঁসার থালা-বাটিতে পরিবেশিত হচ্ছে আহার্য। জানতে চান, ‘কোথাকার কেটারার? কলকাতার না কি?’ জবাবে আরও বড় চমক ‘না না, এরা তো এসেছে আমাদেরই এই গলসি থানার সিহি গ্রাম থেকে।’
বড়-মেজো-সেজো কেটারারেরা বলছেন, কেউ চাইলে আলবত তাঁরা পুরনো দিনের মতো কলাপাতায় লুচি, ছোলার ডাল, সাদা ভাত আর ধোঁয়া ওঠা খাসির মাংস পরিবেশন করতে পারেন। কিন্তু চাইছে কে?
ধবধবে রাজভোগ নয়, খাঁটি ছানার সন্দেশও নয়, এখন যে শেষ পাতে হাসছে স্ট্রবেরি রসগোল্লা!

(তথ্য: রানা সেনগুপ্ত, অর্ঘ্য ঘোষ, কেদারনাথ ভট্টাচার্য,
শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল, গৌরব বিশ্বাস ও সামসুল হুদা)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.