শেষ পর্যন্ত বদলি করা হল উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে।
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার দীপঙ্করবাবুকে বদলি করার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে হাওড়া কমিশনারেটের ডিসি (ট্রাফিক) পদে বহাল করা হচ্ছে। দীপঙ্করবাবুর জায়গায় উত্তর দিনাজপুর জেলার দায়িত্ব নিচ্ছেন অখিলেশ চতুর্বেদী।
একের পর এক খুন। সন্ধে থেকেই দুষ্কৃতীদের বোমার লড়াই। খোদ জেলা সদরেই বাইক-বাহিনীর দাপট।
গত কয়েক মাস ধরে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়া উত্তর দিনাজপুর তথা জেলা সদর রায়গঞ্জের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সোচ্চার হয়েছিল কংগ্রেস। সরব ছিল সিপিএমও। পুলিশ-প্রশাসনের নানা মহল থেকেও ‘পরিস্থিতি ভাল নয়’ বলে মহাকরণে বার বার বার্তা গিয়েছিল। আর, প্রায় ভেঙে পড়া এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির জন্য আঙুল উঠেছিল এক জনের দিকেই, জেলা পুলিশ সুপার দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
ঘটনাচক্রে, তাঁর বদলির নির্দেশ জারির পরের দিন, শনিবার রায়গঞ্জ থানার কাশিবাটি এলাকায় পলাশ বর্মন ( ২০) নামে এক যুবককে গুলি করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। নিহতের বিরুদ্ধে একাধিক খুনের মামলা আছে।
ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠা এই খুনোখুনি সত্ত্বেও পুলিশ সুপার বদলের ব্যাপারে মহাকরণের সাড়া মেলেনি। গত নভেম্বর থেকে ১৩ টি খুনের ঘটনা। যে তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় এক সাংবাদিক এবং স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতাও। পরিস্থিতি সামাল দিতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রায়গঞ্জ পৌঁছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব ও পূর্ত-প্রতিমন্ত্রী সুব্রত সাহা জনরোষের সামনেও পড়েন। কিন্তু মহাকরণের টনক নড়েনি।
বিরোধী দল কংগ্রেস-সিপিএম বহুদিন ধরে সুপারের বদলি দাবি করছে। প্রথমে নীরব থাকলেও তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের নেতা-মন্ত্রীদের একাংশ মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক উত্তরবঙ্গ সফরের সময়ে রায়গঞ্জের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর কাছে দরবার করলে ঘরে-বাইরে ক্ষোভের আঁচ পান
মুখ্যমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত তাঁর নির্দেশেই বদলি করা হল দীপঙ্করবাবুকে। অভিযোগ, খুন-গুলির লড়াই যে ঘটনাই ঘটুক না কেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে যেতেন না পুলিশ সুপার। অথচ ‘ভাল কাজের জন্য’ বেসরকারি সংস্থার সম্বর্ধনা সভায় নিয়মিত দেখা যাচ্ছিল তাঁকে। পুলিশি ব্যর্থতার প্রশ্ন তুলে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি রায়গঞ্জে বন্ধ ডাকলে তাই বিরোধিতাও করতে পারেনি স্থানীয় তৃণমূলও।
বিড়ম্বনায় পড়ে জেলা প্রশাসন মাসখানেক আগে জেলায় সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে চেয়ে মহাকরণে চিঠি পাঠায়। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে দেখে এরপরে দীপঙ্করবাবু নিজেই প্রোটোকল ভেঙে সরাসরি ডিজিকে চিঠি দিয়ে রায়গঞ্জে ‘স্ট্র্যাকো’ মোতায়েন করতে চান। কিন্তু, মূলত মাওবাদী গেরিলা বাহিনীকে রুখতে যে বাহিনী গড়া হয়েছে তা রায়গঞ্জে পাঠানো সম্ভব নয় বলে পুলিশ কর্তারা তাঁকে জানিয়ে দেন।
কিন্তু এত কিছুর পরেও তাঁর বদলি নিয়ে সরকারের এত গড়িমসি কেন?
কংগ্রেসের দাবি, দায়িত্ব নেওয়ার পরেই রায়গঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক তথা পুর-চেয়ারম্যান মোহিত সেনগুপ্তের সঙ্গে দীপঙ্করবাবুর প্রকাশ্যেই মতবিরোধ হয়। সেই সময়ে মোহিতবাবু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি না সামলে এসপি কেন নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, প্রশ্ন তোলেন। দীপঙ্করবাবুর পাল্টা জবাব ছিল: ‘এই সব নেতাদের জনবিচ্ছিন্ন করুন।’ বিষয়টি মোহিতবাবু বিধানসভায় স্পিকারের কাছে অভিযোগ করেন। সে যাত্রায় স্পিকারের হস্তক্ষেপে বিবাদ মেটে।
রায়গঞ্জের কংগ্রেস সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির কথায়, “রায়গঞ্জের আইনশৃঙ্খলার বেহাল অবস্থা। সন্ধ্যার পরে মানুষ ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না। অথচ জেলা পুলিশ সুপারকে দুর্ঘটনাস্থলে দেখাই যাচ্ছে না।” মোহিতবাবুর সন্দেহ, “সামনে পঞ্চায়েত ভোট। তাই হয়তো আমাদের সঙ্গে এসপি-র বিরোধিটা কাজে লাগাতে চেয়েছিল সরকার! ওঁর বদলি নিয়ে তাই এত গড়িমসি।” |