ব্যবধান মাত্র চার দিনের। পাহাড় থেকে সমতলে নেমে নিজের অবস্থান পাল্টে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া যাবে না বলে গত মঙ্গলবারই দার্জিলিংয়ের ম্যালে মোর্চা সমর্থকদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মমতা। শনিবার হুগলির দাদপুরে আর এক সরকারি অনুষ্ঠানে কিন্তু তাঁর গলাতেই শোনা গেল সেই রাজনীতির কথা। যা এর আগেও বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে বারবার শোনা গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রায় দু’ঘণ্টার বক্তৃতার অনেকটা জুড়েই ছিল বাম জমানার ৩৪ বছরের সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের দেড় বছরের কাজের তুলনা। সিপিএমের নাম করে তিনি বলেন, “আগামী ৩৪ বছর একদম চুপ করে থাকবেন। কোনও কথা নয়। কাজ করতে দিন।” তিনি যে সিপিএমের লোকেদের ‘করুণা’ও করছেন, সেই ইঙ্গিতও দিতে ভোলেননি। মমতার কথায়, “আমি প্রতিহিংসাপরায়ণ নই। ফাইলের পর ফাইল হাওয়া। আমি বদলা নিলে ওদের সবাইকে জেলে পচে মরতে হত। আমি কাউকে জেলে পাঠাইনি। ওদের দু’এক জন জেলে গিয়েছেন হাইকোর্টের নির্দেশে।” শুধু দাদপুরেই নয়, এ দিন টাউন হলে সরকারি অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকেও একই কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
ম্যালের সরকারি অনুষ্ঠানের সময়ে রাজনৈতিক স্লোগান দিতে মমতা নিষেধ করেছিলেন। দাদপুরের অনুষ্ঠানে কেন রাজনীতির কথা বললেন, সে উত্তরও মমতা নিজেই দিয়েছেন। তাঁর দাবি, “আমি সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনীতির কথা বলতে পছন্দ করি না। কিন্তু বলতে বাধ্য হই কোনও কোনও সময়ে।” সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক সুর্দশন রায়চৌধুরীর কটাক্ষ, “এ আর নতুন কী? সামনে পঞ্চায়েত ভোট। এখন তো ওঁকে এ সব বলতেই হবে। উনি বুঝতেই পারছেন, পায়ের তলার জমি অনেকটাই আলগা হয়ে গিয়েছে।” |
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে লাগোয়া মহেশ্বরপুর হাইস্কুল মাঠে এই অনুষ্ঠানের পোশাকি নাম ছিল ‘প্রশাসনিক বৈঠক’। কিন্তু আদপে কোনও বৈঠক হয়নি। জেলা জুড়ে ১৫টি প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে কয়েকশো মানুষকে শংসাপত্রও দিয়েছেন মমতা। মৎস্যজীবীদের জাল-হাঁড়ি, ক্লাবের জন্য ফুটবল-ব্যাট-ক্যারম বোর্ড বিলিয়েছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের দিয়েছেন ট্রাই-সাইকেল। শুনিয়েছেন জাঙ্গিপাড়া-বেগমপুরে হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার, সিঙ্গুরে ট্রমা সেন্টার বা জেলায় ছ’টি কিষাণ-বাজার তৈরির মতো কিছু পরিকল্পনাও। অর্থের সংস্থানের প্রসঙ্গে ফের কেন্দ্রকে একহাত নেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “এখান থেকে কেন্দ্র কত টাকা নিয়ে যাচ্ছে, আর দিচ্ছে কত? মাছের তেলে মাছ ভাজা হচ্ছে। মানুষের উপর করের বোঝা না চাপিয়েই আমি রোজগার বাড়িয়েছি।”
রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় মহিলা-নিগ্রহের ঘটনায় তৃণমূল সরকার আমল দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে বিরোধীদের। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, “বোনদের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব ভাইদের নিতে হবে। মেয়েরা কোনও সমস্যায় পড়লে পাড়ার দাদাদের বলবেন। অন্যায়টা অন্যায়। কিন্তু এ নিয়ে মিথ্যাচার সহ্য হয় না।” উন্নয়ন প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, “সিপিএম ৩৪ বছরে ছ’টি নবজাতকদের ইউনিট চালু করেছিল। আমরা দেড় বছরেই ২২টি করে দিয়েছি। আরও ১৮টির কাজ চলছে।” সিপিএমের আমলের তুলনায় রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার ২ শতাংশ কমেছে বলেও তিনি দাবি করেন। তাঁর সংযোজন, “আধুনিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও দিল্লিতে শিশুমৃত্যুর হার এ রাজ্যের তুলনায় বেশি।”
দিনভর অবশ্য খোশমেজাজেই ছিলেন মমতা। কখনও মৎস্যজীবীর মাথায় চাপিয়ে দিয়েছেন ঢাউস হাঁড়ি, কখনও জেলাশাসক মনমীত নন্দাকে পরিয়েছেন বেতের টুপি। পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরীর হাতেও ধরিয়েছেন সুদৃশ্য বেতের পাত্র। হুগলির মাটিতে দাঁড়িয়ে বক্তব্যের একেবারে শেষ লগ্নে ছুঁয়ে যান সিঙ্গুর-প্রসঙ্গও। প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলেন, “সিঙ্গুরে চাষিদের জয় হবে। জমি ফিরিয়ে দেব। মহামান্য আদালতে মামলা চলছে। আমরা ভরসা রাখছি। ওখানে শিল্প-কৃষি দু’টোই হবে।”
সিঙ্গুর কতটা ভরসা পেল, তা অবশ্য অজানা। |