নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বিডিও-দের হাতে অতিরিক্ত দায়িত্ব তুলে দেওয়ার কথা তিনি এর আগেও বলেছিলেন।
এ বার পঞ্চায়েত ভোট যখন ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন বিডিও-দের সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই ঘোষণা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। বিরোধীরা বলছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এটা প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও সরকারের বক্তব্য, গোটা প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। তা হলে তিনি বিডিও-দের সরাসরি যোগাযোগ করতে বললে সমস্যা কোথায়?
শনিবার টাউন হলে ডব্লিউবিসিএস (এগ্জিকিউটিভ) অফিসারদের এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কোনও দরকার হলে আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন। কোনও ভাল প্রস্তাব থাকলে জানাবেন।” রাজ্যের সমস্ত বিডিও-কে তাঁর ই-মেল ও মোবাইল নম্বর দিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিডিও বা ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারদের দায়িত্ব বাড়ানোর কথা এর আগেও বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার ছ’মাসের মাথায়, ২০১১ সালের নভেম্বরে এক বৈঠকে মমতা জানিয়েছিলেন, যেখানে পঞ্চায়েত বন্ধ রয়েছে, অথবা কাজ করছে না, সেখানে জনকল্যাণমূলক কাজের দায়িত্ব নেবেন বিডিও-রা।
তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, গত বছর নভেম্বরে মুখ্যসচিব পদে দায়িত্ব নেওয়ার পরেই জেলাশাসকদের বৈঠকে ডেকে সঞ্জয় মিত্র বলেছিলেন, “আপনাদের অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীকে এসএমএস করছেন। কারা করছেন, তা জানি। এটা করবেন না।” তাঁর নির্দেশ ছিল, তাঁর মাধ্যমেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে জেলাশাসকদের। যা মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের কথার একেবারে বিপরীত। |
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বিরোধীদের আপত্তি কেন?
গত বারেই বামেরা বলেছিলেন, নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান (পঞ্চায়েত)-কে এড়িয়ে প্রশাসনকে দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিন মমতার বক্তব্য জানার পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “পঞ্চায়েত ভোট মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন বিডিওরা। তাঁরাই নির্বাচনী অফিসার। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে নেওয়ার পিছনে পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে।” সেলিম মনে করেন, “সরকারি প্রশাসনের উপরেও ভরসা রাখতে পারছেন না মমতা। তাই মরিয়া হয়ে মহাকরণ থেকে বিডিও-দের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে ভোট করতে চাইছেন।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও বলেন, “এই ঘোষণায় স্পষ্ট, পঞ্চায়েত ভোটে মহাকরণ সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে। ফলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব হবে না।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “সবই করা হয়েছে পঞ্চায়েত ভোটে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে।”
প্রশাসনিক রীতির পরিপন্থী বলেই মমতার এই নির্দেশকে সংবিধান-বিরোধী বলেও মন্তব্য করেছেন প্রদীপবাবু। তিনি বলেন, “বিডিওদের নিয়ন্ত্রণ করেন এসডিও। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন জেলাশাসক। এঁদের মাথায় রয়েছেন মুখ্যসচিব। প্রশাসনের এই পিরামিড পুতুল খেলায় পরিণত হবে।” এত দিন পঞ্চায়েত ভোটে কোনও প্রার্থী ভয়ে বা অন্য কারণে বিডিও অফিসে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারলে এসডিও বা জেলাশাসকের অফিসে তা জমা দিতেন। এখন বিডিও অফিস ছাড়া অন্যত্র মনোনয়ন জমা দিতে পারা যাবে কি না, তা নিয়েও প্রদীপবাবুর সন্দেহ রয়েছে।
প্রশ্ন অবশ্য উঠতে শুরু করেছে অন্য মহল থেকেও। এক সময় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত এবং সরকারি পরিকাঠামো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এক প্রাক্তন শীর্ষকর্তার মতে, প্রশাসন চালানোর জন্য একটি পরিকাঠামো রয়েছে, যার একেবারে নীচের স্তরে আছেন বিডিও। তাঁর দায়বদ্ধতা মহকুমাশাসকের কাছে। এক জন বিডিও কোনও ভাবেই সরকারি, এমনকী ব্যক্তিগত কথাও সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারেন না। তা হলে প্রশাসনিক-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।
আবার এ দিনের সভায় হাজির অনেক অফিসার মনে করেন, বিডিও-রা তাঁদের কথা মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি জানাতে শুরু করলে জেলা প্রশাসনের কোপে পড়বেন। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট গেলে তিনি জেলাশাসক তথা ডিএম-কেই (এটাই নিয়ম) তা বলবেন। তখন ‘ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া’-র অপরাধে বিডিও-এর কাজ করাই অসুবিধা হয়ে যাবে।
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, বিধানসভায় নিরঙ্কুশ হলেও ক্ষমতার তৃণমূল স্তর অর্থাৎ পঞ্চায়েতের অধিকাংশ এখনও বিরোধীদের দখলে। দেড় বছর পরে মমতার জনপ্রিয়তাতেও ক্ষয় শুরু হয়েছে। পঞ্চায়েতে ভাল করা নিয়ে আগেই আশঙ্কা ছিল তৃণমূল নেতৃত্বের। সে জন্য এক সময় পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে আনার কথাও বলেছিলেন তাঁরা। এখন ভোট প্রায় নির্ধারিত সময়েই হচ্ছে। আর জনপ্রিয়তা হ্রাসের আশঙ্কা থেকেই তৃণমূল স্তরের প্রশাসনিক কর্তাদের ক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন মমতা।
ঘটনাচক্রে, রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ‘পিএম টু ডিএম’ (অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সরাসরি জেলাশাসকদের দফতরে অর্থ সাহায্য পৌঁছে দেওয়া) ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। সেই বক্তব্যের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন তৎকালীন সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, তাকে এড়িয়ে প্রশাসনিক স্তরে কাজ করতে চাইছেন রাজীব। সম্প্রতি দলের সহ-সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পরে মনমোহন সিংহ সরকারের ‘ডাইরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার’ বা সরাসরি নগদ হস্তান্তরের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়েও বাবার সেই বক্তব্যের কথা টেনে আনেন রাহুল গাঁধী। প্রদীপবাবু অবশ্য বলেছেন, “রাজীব বা রাহুল যখন এ কথা বলছেন, তখন তাঁদের ধারেকাছে কোনও নির্বাচন নেই। কিন্তু মমতা যখন এ কথা বললেন, তখন পঞ্চায়েত ভোট হতে তিন মাসও বাকি নেই।” প্রশাসনের একাংশ বলছে, ক্ষমতায় থাকাকালীন সিপিএম কো-অর্ডিনেশন কমিটির মাধ্যমে প্রশাসনের তৃণমূল স্তরকে নিয়ন্ত্রণ করত। মমতার দলের তেমন সংগঠন নেই। তাই তিনি তৃণমূল স্তরের প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণটা রাখতে চাইছেন। সরকারি কর্মচারীদের যে সংগঠন এ দিন টাউন হলের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা, তাদের এক কর্তাব্যক্তির অবশ্য দাবি, বিষয়টি সংবাদমাধ্যম ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করছে। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু অকাতরে ফোন নম্বর বা ই-মেল আইডি বিলি করার কথা বলেননি। বলেছেন, প্রকাশ্যে এ ভাবে এ সব বলে দেওয়া যায় না। তবে কারও প্রয়োজন হলে তিনি আমার সচিবের কাছ থেকে নম্বর ও আইডি নিয়ে নেবেন। সমস্যা হলে যোগাযোগ করবেন। ওই কর্তার দাবি, সুতরাং মুখ্যমন্ত্রীর কথা নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বিরোধীদের এই অভিযোগ মানতে নারাজ। পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। গোটা প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তাই বিডিও-দের কাছে তাঁর মোবাইল নম্বর বা ই-মেল আইডি থাকলে বুদ্ধবাবুদের অসুবিধা কোথায়? আমার দফতরের অফিসারদের কাছে আমার মোবাইল নম্বর নেই? এর সঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট বা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কথা আসছে কেন?”
|
কল্পতরু |
• বিশেষ সচিব পদে ডব্লিউবিসিএসের সংখ্যা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০
• ১০-এর বদলে ৮ বছরেই সহকারী সচিব, ২০-র বদলে ১৬ বছরে উপসচিব
• বাড়ছে বেতনবৃদ্ধির পরিমাণ
• ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহায়তায় অফিসারদের জন্য স্পোকেন ইংলিশ কোর্স
• অফিসারদের সন্তানদের জন্য জেলায় মডেল স্কুল |
|