পন্টিং
জ ঠাম্মা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরবেন। ঋজু সেই জন্য সকাল সকাল স্নান সেরে টেবিলে রাখা জলখাবার খেয়ে নিয়েছে, যাতে তাকে তাড়া দিয়ে মায়ের সময় নষ্ট না করতে হয়। সুজির হালুয়াটাকে রুটির মধ্যে ভরে রোল বানিয়ে সেটাকে মাখন লাগানোর ছুরি দিয়ে টুকরো করেছে। নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট না করে ঋজু খেতে পারে না। বাবা ভোরেই হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছেন। ঠাম্মাকে বাড়ি আনার আগে নানা রকম কাগজপত্র, ফর্ম ইত্যাদি ভরতে হবে। মা এখন বেরোবেন ঠাম্মার সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সে আসবেন। ঠাম্মার পেটে একটা সার্জারি হয়েছে, নড়াচড়া বারণ, তাই হাসপাতাল থেকেই অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
পন্টিং সকাল থেকেই বারান্দায় বসে আছে। একটু আনমনা। গত সাত-আট দিন ধরে ভাল করে খাচ্ছে না, সেই জন্য তার মোটাসোটা ঘাড়টা বেশ সরু হয়ে গিয়েছে। অন্য সময় হলে পন্টিং আহ্লাদির মতন টবে ফোটা ফুলগুলোকে দেখে ঘাড় কাত করে থাকে। মা বলে, ও নাকি ফুল দেখতে ভালবাসে। প্রজাপতি উড়তে উড়তে কাছে এসে গেলে একটা থাবা তুলে তাদের ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু লাফায় না। হয়তো ও বোঝে প্রজাপতি সুন্দর।
পন্টিং ঠাম্মাকে ভীষণ ভালবাসে। বাবা বলে, ও নাকি ঠাম্মাকেই নিজের মা ভাবে। হবে না-ই বা কেন? দু’বছর আগে এক ঘোর বর্ষার রাতে কারা যেন খুদে এক বিড়ালছানাকে ওদের বারান্দার নীচে ফেলে চলে গিয়েছিল। কাদা-জল-মাখা, ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে। শুতে যাওয়ার আগে কাঁথাটা গায়ে দিতে দিতে ঠাম্মা বললেন, হ্যাঁ রে খোকন, বিড়ালছানার ডাক শুনতে পেলি? কোথায়, কত বিড়ালই তো ডাকে। তাই বাবা কাঁথাটা ভাল করে ঠাম্মার গলা অবধি টেনে দিয়ে বলল, ডাকছে হয়তো! তুমি এ বার ঘুমোও। আলোটা নেভাই। না, রে, এ যে আমাদের বারান্দার নীচেই। তুই একটু নীচে যা।
অত রাতে ভিজে পন্টিংকে গরম চাদরে মুড়ে মা দুধ খাওয়াতে লাগল। কী সাঙ্ঘাতিক ভীতু বেড়াল, কারও হাত দেখলেই পালিয়ে যাচ্ছে। মা বলল, হয়তো কেউ ওর ওপর খুব অত্যাচার করার চেষ্টা করেছে, বা ভয় দেখিয়েছে।
দু’তিন মাসেই সেই ভিজে বেড়ালছানা এমন দুর্ধর্ষ দাপুটে হয়ে উঠল যে বাবা ওর নাম দিল পন্টিং। রিকি পন্টিং-এর নামে। ঋজু জানে, পন্টিং বাড়ির মধ্যে ওকেই যা একটু সমীহ করে চলে, দূরে দূরে থাকে, হয়তো এখনও মনে কোনও ভয় আছে। বাবা, মা আর ঠাম্মার গায়ে যেমন ঝাঁপায়, বিছানার চাদরের নীচে ঘুমোয়, ঋজুর সঙ্গে তেমন করে না। কিন্তু ও যখন নখ দিয়ে ঋজুর ম্যাথস খাতার কভারটা আঁচড়ে ছিঁড়ে দিয়েছিল, ঋজু ওকে একটুও বকেনি। হয়তো ওর ভয়টা আস্তে আস্তে চলে যাবে।
ছবি: সুমন চৌধুরী
মাছ, দুধ, ভাত, বিস্কুট সব কিছু পেট ঠেসে খেয়ে দিব্যি নাদুসনুদুস হয়েছিল পন্টিং, কিন্তু ঠাম্মা হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকেই ওর খাবারে অরুচি। সারা দিন বারান্দাতেই বসে আছে, বড় গেটটার দিকে তাকিয়ে, ঠাম্মা যে ও দিক দিয়েই গিয়েছিল। মা বার বার ডেকে সেধেও খাওয়াতে পারে না। খাটেও ওঠে না পন্টিং। রাতে নিজের কম্বলটার ওপর মনমরা হয়ে ঘুমোয়। হাসপাতালে কী হচ্ছে না হচ্ছে বাবা আর মা অবশ্য পন্টিংকে ডেকে ডেকে শোনায় ডাক্তারবাবুরা কী বললেন, অপারেশন কেমন দিব্যি হল, ঠাম্মা উঠে বসে স্যুপ খাচ্ছে ইত্যাদি। পন্টিং চুপচাপ শোনে, কিন্তু নিজের খাবারের থালাটায় মুখ দেয় না।
মা চিন্তিত হয়ে বলল, ওকে না হয় নিয়েই যাও, নিজের চোখে মামণিকে দেখে আসুক। বাবা বলল, কী করে নেব? দেখছ না ওয়ার্ডের বাইরে লেখা ‘চিলড্রেন আন্ডার এইট নট অ্যালাউড’। মা বলল, ওর আসল বয়স কে-ই বা জানছে? তিন, চার না আট? বয়স না বলে ওজনটাই বোলো না হয়।
ঋজু রেগে বলে, আমি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলে তোমরা এমন করতে? কান ধরে ঠেসে খাইয়ে দিতে না? ওকেও দলা করে ভাত মেখে মুখে ঠুসে দাও!
মা হেসে বলে, ওকে জোর করে খাওয়ানো যায় নাকি?
যাক দিন দশেক পরে এখন সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি। ঠাম্মাও ফিরে আসছে। পন্টিংও খেতে আরম্ভ করবে নিশ্চয়ই। সকালের কাগজে দিয়েছে কলকাতায় শৈত্যপ্রবাহ। ঋজুর যদিও শীত করছে না, তবু একটা হাফ হাতা সোয়েটার পরে গলায় ঠাম্মার বোনা মাফলারটা জড়ালো। না হলে ঠাম্মা এসেই ‘এ কী, তুই গায়ে গরম জামা দিসনি’ বলে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। অপারেশনের পর নাকি উত্তেজনা ভাল নয়, বাবা বলেছে।
ওই তো, ওই আসছে নীল বাতি জ্বালিয়ে, সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স। পিছনে ট্যাক্সিতে বাবা আর কাকু। পন্টিং ঠাম্মা এসে গিয়েছেন, দ্যাখ, বলে ঋজু একটু ওর কান টেনে নীচে দৌড়ে চলে গেল।
তার পর যা হয়। ধরে ধরে ঠাম্মাকে নিজের খাটে শোওয়ানো, পড়শিদের উঁকিঝুঁকি, বাবা আর কাকা সাবান দিয়ে ট্যাক্সি-মাখা হাত ধুয়ে চেয়ারে বসেছেন, মা পাতলা হরলিক্স বানিয়ে চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে আসছে ঠাম্মা ঋজুর গালে আঙুল বুলিয়ে বলছেন, আহা রে, সোনা আমার কত রোগা হয়ে গেছিস...
রোগা শুনেই ঋজুর মনে পড়ল পন্টিং-এর সরু হয়ে যাওয়া বাদামি ঘাড়টা। আমি রোগা হইনি, হয়েছে তো পন্টিং। বলেই ওর মনে হল, আরে পন্টিং কোথায়? এক বারও এল না তো? অভিমান করে কোনও খাটের তলায় ঘাপটি মেরে নেই তো?
বাড়ির ভিতরটা, বারান্দা, সব তন্ন তন্ন করে দেখে ঋজু ফিরে এল। উপর থেকে নীচের ফাঁকা বাগান আর লনটাও দেখা যাচ্ছে। পন্টিং কোথাও নেই। মা-বাবাকে ইশারায় বাইরে ডাকল ঋজু। পন্টিং কোথায় গেল? বাবার মুখ চুন। ঠাম্মা জানলে তো ভীষণ মনখারাপ করবেন।
মা থালায় পন্টিং-এর খাবার মেখে দরজাটা খুলে ডাকতে লাগলেন পন্টিং এসো, এসো, মামণি এসেছেন!
এমন এক সময় পন্টিং পাড়া বেড়াতে যাবে, ভাবাই যায় না। গত দশ দিন বারান্দাতেই বসে আছে পথ চেয়ে। কেউ কি তুলে নিয়ে গেল ওকে?
ঠাম্মা বললেন, বউমা, পন্টিং কই? একটু ঘুম পাচ্ছে, সকালে একটা ওষুধ দিয়েছে... মা, বাবা, কাকা একসঙ্গে বলতে লাগল, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি ঘুমোন, তুমি ঘুমোও ইত্যাদি যাতে একটু সময় পাওয়া যায় হাতে।
ঠাম্মা ঘুমোনোর আধ ঘণ্টা পরে দরজায় বেল বাজল। পন্টিংকে কোল থেকে নামিয়ে একটা লোক বলল, কই, এক কাপ চা দিন তো? আর এই আপনাদের বেড়াল!
আরে, ইনিই তো অ্যাম্বুল্যান্স চালক, শম্ভুবাবু। পন্টিংকে কোথায় পেলেন?
আর বলেন কেন? দরগা রোডে একটা চায়ের দোকানের সামনে রাস্তা ফাঁকা দেখে গাড়ি থামিয়েছি, হঠাৎ শুনি ম্যাও, তার পর একটা বড় মোটা বাদামি ল্যাজ বেড়ালটা ছাদ থেকে লাফিয়ে আমার কোলে। তখনই মনে পড়ল আপনাদের বাড়ির গেট থেকেই দেখছিলাম রেলিং-এ বসে একটা বাদামি বেড়াল নীচে ঝুঁকে দেখছে, আমি ভাবছি পড়ে না যায়, তাই হয়েছে, লাফিয়ে পড়েছে অ্যাম্বুল্যান্সের ছাদে! দরগা রোডে আর চা খাওয়া হল না। দিন দেখি, গরম এক কাপ চা!
হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন, এই দিই মা বলল। পন্টিং লাফিয়ে ঠাম্মার ঘরে ঢুকে সোজা পায়ের নীচে, কম্বলের তলায় চলে গিয়েছে। ওখানে অবশ্য আট বছরের কমবয়সি বাচ্চার ঢুকতে মানা নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.