উত্তরপ্রদেশের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী আজম খাঁ বলিয়াছেন, বাবরি মসজিদের পরিবর্তে যদি এক বিশাল জনসমষ্টি তাজমহলকে চূর্ণ করিতে সমবেত হইত, তিনি তাহাদের নেতৃত্ব দিতেন। কারণ দেশবাসীর খাদ্য বা বাসস্থানের ব্যবস্থা না করিয়া প্রেমিকার স্মরণসদন গড়িতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা উচিত কর্ম নহে। শুনিয়া কেহ আজম-কে উন্মাদ বলিয়াছেন, কেহ ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করিয়াছেন। কিন্তু কথাটি অনুধাবনযোগ্য। মানুষের দেহ ও মন উভয়েরই খাদ্য আবশ্যক, এ উক্তি আমরা সহজেই ফুকারিয়া থাকি। কিন্তু প্রশ্ন হইল, দুইটিই কি সমান প্রয়োজনীয়? কাব্য করিয়া বলা যায়, রুটি অপেক্ষা ফুল গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের তীব্র অসহ বেদনার সম্মুখে সেই উক্তিকে নিতান্ত ন্যাকা উচ্চারণ মনে হইবে না কি? শাহজাহাঁ ছিলেন দেশাধিপতি, প্রজাপালক। তাঁহার প্রধান কার্য দেশবাসীর মূল ও প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি পূরণ। মুষ্টিমেয় লোকের উচ্ছ্বসিত বাহবা উৎপন্ন করিবার জন্য কেহ যদি অধিকাংশ মানুষের খাদ্য-পরিধান-আশ্রয় কাড়িয়া তাহাদের ন্যূনতম অধিকারগুলিকে অবহেলা করেন, তাঁহাকে উত্তম শাসক বলা যায় না। সেই দৃষ্টিকোণ হইতে, তাজমহল কেন, যে কোনও শিল্পসমারোহই কোটি কোটি ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত নিরাশ্রয় মানুষের অপমান। মানুষ হাসপাতালে বেড না পাইয়া মাটিতে শুইয়া ছটফট করিতেছে, জীবনদায়ী ঔষধ সংস্থানের টাকা নাই, তবে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে ফিল্মোৎসব কেন? |
তদুপরি, মনের খাদ্য না পাইয়া এমনিতেই নিযুত মানুষ বাঁচিয়া আছে। কোনও তত্ত্ববিদ তাহাদের জীবনকে ‘হীন’ আখ্যা দিতেই পারেন, কিন্তু আমরণ এক অক্ষর কাফকা না পড়িয়া বা কখনও তাজমহল না দেখিয়া তাহারা দিব্য সুখ-দুঃখময় ধরার সুধা ওতপ্রোত ভাবে শুষিয়া লইতেছে। দেখিয়া মনে হয়, সৌন্দর্যবিলাস মনুষ্য-সভ্যতায় কিছু অতিরিক্ত গুরুত্ব পাইয়া গিয়াছে, তাহার মহিমা অতিস্ফীত। আবার, যদি উপরোক্ত যুক্তিটি মানিতে হয়, তবে যত ক্ষণ সমগ্র বিশ্বের একটি মানুষও ক্ষুধার্ত রহিয়াছে, একটি মানুষও জল না পাইয়া ছটফট করিতেছে, তত ক্ষণ কোনও মানুষের নীতিগত অধিকার নাই একটিও শিল্প সৃষ্টির। কারণ সে অবান্তর কর্মে সময় ও সামর্থ্য ব্যয় করিতেছে, ভ্রাতার অন্ন জোগাইবার চেষ্টা না করিয়া শক্ত অনুপ্রাস খুঁজিতেছে। ইহাকে প্রসারিত করিলে আমরা প্রত্যেক ব্যক্তির নিতান্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত সকল অর্থ বাধ্যতামূলক দান করিবার উপসংহারেও পৌঁছাইব, কিন্তু আপাতত কথা শিল্পে সীমায়িত থাকুক। যে হেতু কোনও মুহূর্তেই কেহ নিশ্চিত হইতে পারে না যে, বিশ্বের সকল মানুষ জৈবিক উপকরণগুলি সম্যক লাভ করিয়াছে, সে হেতু কাহারও কোনও শিল্প রচনাই কখনও সঙ্গত হইবে না। তাহা হইলে পৃথিবী কেবল নীরস হইয়াই পড়িবে না, এই দাবিতে শিল্পোদ্যোগী মানুষের অধিকারও তো হৃত হইবে। যে খাইতে পাইতেছে না তাহার যেমন অধিকার আছে খাদ্য চাহিবার, যে খাইতে পাইতেছে তাহারও অধিকার আছে প্রাথমিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু চাহিবার, নিজ হৃদয়ে ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং...’ পঙ্ক্তিটি জাগ্রত হইলে তাহাকে প্রকাশ করিবার। আনন্দ লাভ করিবার, অন্যকে আনন্দ দিবার। তাই যুগে যুগে দুই প্রবণতারই সহাবস্থান। অর্থ, শ্রম ও প্রতিভা ব্যয়ে মানুষ এমন কিছু গড়িবে, কেজো হিসাবে যাহার যৌক্তিকতাই নাই, অথচ কিছু মানুষ তাহা ভোগ করিয়া তুরীয় অনুভূতির সন্ধান পাইবেন। আবার কিছু মানুষ বলিবেন, এই অনুভূতি মূল্যহীন, কারণ সমষ্টির গণিতে ইহা বঞ্চনার নামান্তর। তাজমহলের ন্যায়ই, এই তর্কও শাশ্বত। |