|
|
|
|
গাঁধীর আদর্শকেই সম্মাননা: ঝর্ণাধারা |
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
দশ বছরের ছোট্টটি তখন তিনি। কিন্তু ছেচল্লিশে নোয়াখালির দাঙ্গার সেই বীভৎস ছবি এখনও তাঁর স্মৃতিতে টাটকা। শৈশবের সেই ক্ষতই তাঁকে পাথেয় জুগিয়েছে মানুষের সেবা করার। বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে প্রথম পদ্মশ্রী খেতাব পাওয়ার পরে স্মৃতিতে ডুব দিচ্ছেন ঝর্ণাধারা চৌধুরী।
গোটা জীবন সমাজসেবার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার জন্য আরও এক জন মানুষ তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। নোয়াখালির দাঙ্গার পর শান্তির বাণী নিয়ে গাঁধী যখন নোয়াখালি গিয়েছিলেন, ছোট্ট ঝর্ণাধারা তখন প্রাণ বাঁচাতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে লুকিয়ে রয়েছেন অসমে।
“আমাদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, বহু আত্মীয়স্বজনও খুন হন। অসমে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে পথের দু’ধারে শুধু খুন হওয়া মানুষজনের দেহ পড়ে থাকতে দেখেছি”, সুদূর নোয়াখালি থেকে দূরভাষে জানাচ্ছেন তিনি। এখন সেই নোয়াখালির জমিই আঁকড়ে রয়েছেন। তাঁর কথায়, “গাঁধীবাবাকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়নি, কিন্তু তাঁর দর্শন আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। অসম থেকে যখন গ্রামে ফিরি, হিংসা থেমেছে, কিন্তু নোয়াখালি যেন শ্মশান।”
গাঁধীর প্রয়াসে এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে, ওই অল্প বয়সেই স্থির করেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যই কাজ করবেন। গাঁধীর বার্তা ছড়িয়ে দেবেন গোটা দেশে। তাই ১৭ বছর বয়সে বোনকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের মধ্যেই শুরু করছিলেন সমাজের বঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুল। |
|
নোয়াখালির গাঁধী আশ্রমে সমাজসেবী ঝর্ণাধারা চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র |
“স্কুল চালানোর জন্য কোনও অর্থই ছিল না আমাদের। সপ্তাহে মাঝেমধ্যেই উপোস করে বাজার খরচ বাঁচাতাম। সেই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য বই আর অন্য জিনিসপত্র কেনা হত।” তাঁদের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, এই কারণ দেখিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই সেই স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। হার না মেনে ঝর্ণা ঘুরতে থাকেন ঢাকা, কুমিল্লা-সহ গোটা বাংলাদেশ। প্রচার করতে থাকেন গাঁধীর দর্শন। অনেক সমাজসেবী সংস্থায় কাজ করার পরে শেষ পর্যন্ত যোগ দেন নোয়াখালির গাঁধী আশ্রম ট্রাস্ট-এ। সেখানকার জমিদার হেমন্তকুমার ঘোষ তাঁর বাড়ি এবং আড়াই হাজার একর জমি দান করেছিলেন এই আশ্রমের জন্য। নোয়াখালি এসে গাঁধী একটি দিন ছিলেন এই বাড়িতে।
মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে থেকেই তোপের মুখে পড়তে হয় আশ্রমটিকে। পাক সেনারা জমি কেড়ে নেয়। ভারতের চর অভিযোগে আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত অনেককেই জেলে পাঠানো হয়। ওই বাড়িতেই পাক সেনাদের গুলিতে খুন হন গাঁধীজির ৪ জন শিষ্য। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিস্থিতি ক্রমশ বদলায়।
দীর্ঘ এই টালমাটাল জীবন পেরিয়ে ভারত সরকারের পক্ষে পদ্মশ্রী পাওয়ার অনুভূতিটা কেমন? ঝর্ণাধারার কথায়, “এক সঙ্গে অনেকগুলি বিষয়ের স্বীকৃতি হিসাবেই আমি দেখছি পুরস্কারটিকে। প্রথমত, গাঁধীর মতাদর্শকে সম্মান জানানো হল। দ্বিতীয়ত, এর আগে ভারতের এই সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান কোনও বাংলাদেশি নাগরিককে দেওয়া হয়নি। সুতরাং ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর প্রশ্নেও ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিন নম্বর, শুধু আমি নয়, আমার মাধ্যমে বাংলাদেশের মহিলাদের সেবাধর্মকেও উৎসাহিত করা হল।” ৭৭ বছরের ঝর্ণাধারা এখনও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন নোয়াখালির গাঁধী আশ্রমের সেবাকাজকে আরও প্রসারিক করার কাজে। তাঁর কথায়, “গাঁধীজি সেই সে বার এখানে ঘুরে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনও বড় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এই নোয়াখালিতে হয়নি।” পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় যা শোনা যায়নি, এত ক্ষণে সেই গর্বের ছোঁয়া লাগল ঝর্ণাধারা চৌধুরীর কণ্ঠে। |
|
|
|
|
|