|
|
|
|
৪৮ ঘণ্টার বন্ধেই সমর্থন দেওয়ার ফরমান কারাটদের |
সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
আলিমুদ্দিনের আর্জির জবাবে দিল্লির এ কে জি ভবন থেকে এল শীতল উপেক্ষা!
টানা দু’দিনের সাধারণ ধর্মঘট ডেকে খেটে-খাওয়া মানুষের জীবিকাকেই সমস্যার মুখে ফেলা কেন, প্রশ্ন উঠেছিল সিপিএম রাজ্য কমিটিতে। দলের অন্দরের মনোভাব আঁচ করে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু শুক্রবার ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বকে আর্জি জানিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের কথা মাথায় রেখে ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন, ২১ ফেব্রুয়ারি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রকে ছাড় দেওয়া হোক। ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট নিয়ে রাজ্য কমিটিতে যে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে লিখিত ভাবে তা-ও জানিয়েছিলেন বিমানবাবুরা। আর শনিবারই সিপিএমের সর্বভারতীয় সদর দফতর থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্য এবং সব রাজ্য কমিটির কাছে নির্দেশিকা এবং ৬ পাতার খসড়া বক্তব্য পাঠিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল, বর্তমান পরিস্থিতিতে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটই লড়াইয়ের একমাত্র পথ!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
এ দিনই হুগলির দাদপুরে এক অনুষ্ঠানে খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকার প্রসঙ্গ তুলে ধর্মঘটের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁর কথায়, “বছরে নিয়ম করে দু’টো করে বন্ধ। এ আমি একেবারে হতে দেব না। যাঁরা খুচরো ব্যবসা করেন, বাজার নিয়ে বসেন, তাঁদের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। কেউ জোর করে বন্ধ করতে চাইলে প্রশাসনকে জানান। প্রশাসনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছেন। তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তাঁর বক্তব্য, “দু’দিনের ধর্মঘট তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্য ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে অনড়। তাঁরা খসড়া বক্তব্য পাঠিয়ে দলের কর্মী ও সমর্থকদের নির্দেশ দিয়েছেন, ২০-২১ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটকে ‘সর্বান্তঃকরণে’ সমর্থন করতে হবে! রাজ্য কমিটিতে ওঠা প্রশ্নের কোনও উল্লেখ এই নথিতে নেই। একই সঙ্গে অনুপস্থিত ভাষা দিবস-জনিত বিশেষ পরিস্থিতির প্রসঙ্গও! কলকাতায় দু’দিনের বৈঠকে আলোচনা এবং আলিমুদ্দিনের আবেদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এমন কড়া খসড়া বক্তব্য জারি হওয়ার ঘটনায় ভিন্ন তাৎপর্যই খুঁজে পাচ্ছে সিপিএমের একাংশ। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের ব্যাখ্যায়, “সব ক’টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন পরিকল্পনা করে গত সেপ্টেম্বরে এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। এখন এ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলা যে অর্থহীন, সেটাই সুকৌশলে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।” ওই খসড়া থেকে পুস্তিকা তৈরি করে ধর্মঘটের সমর্থনে অবিলম্বে প্রচারের মাত্রা বাড়াতেও বলা হয়েছে রাজ্য কমিটিগুলিকে।
এই নির্দেশ জারির অন্তরালে বঙ্গ ব্রিগেডের সঙ্গে এ কে জি ভবনের পুরনো ঠান্ডা লড়াইয়ের ছায়াও দেখছেন দলের কেউ কেউ। পুরনো সেই সমীকরণে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তুলনায় উদারনৈতিক লাইনের প্রতিনিধি আর সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট কট্টরপন্থী তাত্ত্বিক। এ বার দু’দিনের ধর্মঘট ডাকা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, দলের অন্দরে তাতে সায় আছে বুদ্ধবাবুর। খসড়ার মাধ্যমে কারাট তাঁকেই জবাব দিলেন কি না, জল্পনা চলেছে সিপিএমে।
এই খসড়ার কয়েকটি অংশ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই সিপিএম সূত্রের অভিমত। যেমন, যেখানে বলা হয়েছে: ‘গত তিন বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাধ্যমে যে সব দাবি তুলে ধরা হচ্ছে, তার সম্পর্কে সরকারের সামগ্রিক অনীহাই দু’দিনের সাধারণ ধর্মঘটকে আবশ্যিক করে তুলেছে’। গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি একই রকম দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট করার পরেও অবস্থার যে পরিবর্তন হয়নি, সে কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। আর সেটাকেই যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছে, এক দিনের ধর্মঘটে সাড়া মেলেনি বলে এ বার দু’দিন কাজ বন্ধ রাখতে হবে! খসড়ার ভাষায়, ‘সরকারের জনবিরোধী ও শ্রমিক-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে জনপ্রিয় সংগ্রামকে শক্তিশালী করাই আমাদের সামনে অবস্থা পরিবর্তনের একমাত্র পথ’। অর্থাৎ ধর্মঘটই জনপ্রিয় পথ! এবং চেনা ও বহু ব্যবহৃত সেই অস্ত্রই একমাত্র ভরসা! যা দেখে সিপিএমেরই রাজ্য কমিটির এক সদস্য বলছেন, “এই ভাবে ভাবলে তো এর পরের বছরগুলোতে তিন বা চার দিনের ধর্মঘট ডাকতে হবে!”
তবে বঙ্গ সিপিএম হাল ছাড়ছে না। ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান ব্যাহত হলে শিক্ষিত, সচেতন জনসমাজের কাছে ভুল বার্তা যাবে, এই যুক্তিকে সামনে রেখেই ২১ ফেব্রুয়ারির জন্য কিছু ছাড়ের ব্যবস্থা করতে তারা এখনও সচেষ্ট। তার জন্য আলোচনা হবে সব ট্রেড ইউনিয়নের রাজ্য স্তরের নেতৃত্বের মধ্যে। কারাট-ঘনিষ্ঠ এক সিপিএম নেতা পাল্টা যুক্তি দিতে ছাড়ছেন না “ধর্মঘট মানে কাজ বন্ধ। ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানকে বাধা দেওয়ার কথা কেউ তো বলেনি! সেটা নিয়ে মাথাব্যথাও তাই অহেতুক!”
বুদ্ধের বাংলার গরম যুক্তিতে কারাটের দিল্লির ঠান্ডা জল! |
|
|
|
|
|