নাসার কন্ট্রোল রুম শুনতে পেল মিশন কম্যান্ডারের গলা, “রজার..”। তার পরে টানা নিস্তব্ধতা।
আকাশের বুক চিরে ছুটে আসছে তিনটে আলোর রেখা। তার পর.সব শেষ।
২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, মহাকাশ অভিযান সেরে পৃথিবীতে ফেরার পথে মাটি থেকে প্রায় দু’লক্ষ ফুট উঁচুতেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল মহাকাশযান কলম্বিয়া। মারা যান প্রথম ভারতীয় মহিলা মহাকাশচারী কল্পনা চাওলা ও তাঁর ছয় সঙ্গী। শুক্রবার সেই ঘটনার দশ বছর পূর্তিতে একাধিক স্মরণসভার আয়োজন করেছে নাসা। নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান অ্যালার্ড বিউটেল জানান, আরলিংটন জাতীয় সমাধিক্ষেত্রের ‘অ্যাস্ট্রোনট মেমোরিয়ালে’ নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর চার্লস বলডেন-সহ উচ্চকর্তারা হাজির থাকবেন। ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের স্পেস মিরর মেমোরিয়ালে শ্রদ্ধার্ঘ্য-অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে নাসার টিভি চ্যানেল। মৃতদের শ্রদ্ধা জানাতে সংগঠনের পতাকাও অর্ধনমিত থাকবে। বিউটেল বলছেন, “কল্পনা-সহ সাত জন মহাকাশ অভিযান ও গবেষণার উন্নতি করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। তাই তাঁদের এই সম্মান প্রাপ্য-ই।”
প্রাক্তন ছাত্রীর মৃত্যুতে অনুষ্ঠান করছে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ও (আরলিংটন)। এখানেই এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করেছিলেন কল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাওলা সভাগৃহে (কল্পনার নামাঙ্কিত) অনুষ্ঠান হবে। দুর্ঘটনার আনুমানিক সময় হিসেব করে শুক্রবার সকালে সাদা বেলুন ওড়াবেন বর্তমান পড়ুয়ারা। তবে এ সব থেকে দূরে রয়েছে কল্পনার মাতৃভূমির মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, ইসরো। তাদের প্রধান মুখপাত্র দেবীপ্রসাদ কার্নিক বললেন, “আমাদের কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি।” শুধু স্মরণসভা নয়, কল্পনাদের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষাও নিয়েছে নাসা। আর সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েই তারা তৈরি করেছে নতুন মহাকাশযান। যার নাম দেওয়া হয়েছে, ওরিয়ন। বাংলা অর্থ ‘কালপুরুষ’। চলতি দশকের শেষে তা নিয়ে ফের মহাকাশে পাড়ি দিতে পারেন নাসার নভশ্চরেরা।
ঠিক কী ঘটেছিল দশ বছর আগের ১ ফেব্রুয়ারিতে?
নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই দিন সকাল থেকেই অস্বাভাবিক ‘রিডিং’ ধরা পড়ছিল ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে নাসার মিশন কন্ট্রোল রুমের কম্পিউটার মনিটরে। কলম্বিয়ার তাপমাত্রা এবং বায়ুচাপের সেন্সরগুলি কাজ করছিল না। উপায় না দেখে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছিল কলম্বিয়ায়।
সকাল ৮টা ৫৯ মিনিট ৩২ সেকেন্ড। কন্ট্রোল রুমে ভেসে এল কলম্বিয়ার মিশন কম্যান্ডার রিক হাসব্যান্ডের গলা। শুধু ‘রজার’ শব্দটি শোনা গিয়েছিল। এর পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মহাকাশযান ভেঙে পড়ার খবর মেলে।
কেন ঘটেছিল দুর্ঘটনা?
নাসার তদন্ত বলছে, মূল সমস্যাটা তৈরি হয়েছিল মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। কলম্বিয়ার বাইরের দিকের ট্যাঙ্ক থেকে এক টুকরো ফোম খসে পড়ে ধাক্কা মারে বাঁ দিকের ডানায়। নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধাক্কার চোটেই বাঁ দিকে একটি ছিদ্র হয়েছিল। ফেরার পথে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পরে ওই ছিদ্র দিয়ে হাওয়া ঢোকে মহাকাশযানের ভিতরে। আগুন ধরে যায় কলম্বিয়ায়। শুধু তাই নয়, মহাকাশচারীদের কেবিন, বসার আসন, লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমেও বেশ কিছু ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে নাসা। ওরিয়নে ওই সব কিছুরই নতুন করে নকশা করা হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মহাকাশযানের আদলও। কী রকম?
হিউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টারে ওরিয়ন তৈরির দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ারেরা জানাচ্ছেন, ডানাওয়ালা মহাকাশযানের বদলে ওরিয়ন দেখতে হবে অনেকটা শঙ্কুর মতো। যাতে উৎক্ষেপণ বা অবতরণের সময় সময় বিপদ বুঝে সামনের অংশটি আলাদা হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, আসনগুলি হবে রেসিং-কারের মতো। বদলাচ্ছে মহাকাশচারীদের পোশাক, লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম। নাসা বলছে, দুর্ঘটনার সময় গ্লাভস বা হেলমেট পরার সময় পাননি কল্পনারা। ‘ওরিয়ন’-এ বায়ুচাপের হেরফের বুঝে মহাকাশচারীদের পোশাক নিজে থেকেই হাওয়া ভরে নেবে। শুরু হয়ে যাবে অক্সিজেন সরবরাহও। ইঞ্জিনিয়ার দলের প্রধান ডাস্টিন গোমার্ট বলছেন, “ওরিয়নের প্রত্যেকটা বিষয়ই দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করবে। কলম্বিয়ার সদস্যেরা তো আমারও বন্ধু ছিল।”
ডাস্টিনের কথাতেই পরিষ্কার, মহাকাশ অভিযানকে সুরক্ষিত করতে কল্পনাদের স্মৃতিকেই হাতিয়ার করছে নাসা। |