মকবুল ফিদা হুসেনকে চলে যেতে হয়েছিল। তেমন হলে তিনিও দেশ ছাড়তে বাধ্য হবেন।
তিনি কমলহাসন। বাড়ি-গাড়ি বন্ধক রেখে বানিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের ছবি ‘বিশ্বরূপম’। নিজের রাজ্য তামিলনাড়ুতেই সে ছবির ভবিষ্যৎ আরও এক বার অনিশ্চিত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আবেগে আঘাত লাগবে, আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হবে এই সব যুক্তিতে ছবিটি নিয়ে তামিলনাড়ু সরকারের সঙ্গে কমলের দীর্ঘ সংঘাত চলছে। গত কাল রাতে মাদ্রাজ হাইকোর্ট ছবিটি দেখানোর ব্যাপারে সম্মতি দেয়। আজ সকালে তার বিরুদ্ধে ফের আপিল করে রাজ্য সরকার। তারই জেরে নতুন করে জারি হয় স্থগিতাদেশ।
হতাশ কমল তার পরেই সখেদে বলেন, “মনে হচ্ছে তামিলনাড়ু চায়, আমি এখানে না থাকি। আমাকে একটা ধর্মনিরপেক্ষ জায়গা খুঁজতে হবে থাকার জন্য। যদি এ দেশে সেটা না পাই, তা হলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।”
কমল বরাবরই দাবি করে আসছেন, ফিল্মটিতে এমন কিছুই নেই যা এ দেশের কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আঘাত করতে পারে। কারণ, ছবিটির পটভূমি আফগানিস্তান। সুপারস্টার রজনীকান্তও কমলের সমর্থনে এগিয়ে এসে বলেছিলেন, “আমি কমলকে ৪০ বছর ধরে চিনি। সংখ্যালঘুরা আঘাত পান, এমন কোনও কাজ ও করতে পারে না।” এর পরেও আজ সকালে সংখ্যালঘুদের দাবি মেনে ফিল্মটির কিছু অংশ বাদ দিতে রাজি হয়ে যান কমল। ওই সম্প্রদায়ের কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় নেতার জন্য বিশেষ একটি শো-এরও ব্যবস্থা করা হয়। তাঁরা ছবি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করেছিলেন কমল। কিন্তু বিধি বাম! |
সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি। বুধবার চেন্নাইয়ে। ছবি: রয়টার্স |
এখানে থাকতে না পারলে এমন একটা জায়গা খুঁজব, যেখানে ধর্ম নেই। যদি ধর্মনিরপেক্ষ কোনও রাজ্যই খুঁজে না পাই, তা হলে অন্য দেশে চলে যেতে হবে।
কমলহাসন |
|
লাগাতার টানাপোড়েনের পর গত কালই রাত দশটা নাগাদ ‘বিশ্বরূপম’ তামিলনাড়ুতে মুক্তি পাবে বলে অন্তর্বর্তী রায় দিয়েছিল মাদ্রাজ হাইকোর্ট। কিন্তু বিচারপতি কে বেঙ্কটরামনের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তামিলনাড়ু সরকার আজ ফিল্মটির উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখার জন্য পুনরায় আবেদন করে। সরকারের তরফে আইনজীবী এ নবনিথকৃষ্ণ আজ অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি এলিপ ধর্মা রাও এবং বিচারপতি অরুণা জগদীশনের ডিভিশন বেঞ্চের কাছে জানান, ‘বিশ্বরূপম’ দেখানো হলে রাজ্যের শান্তি-নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এর পরেই আজ ফের ‘বিশ্বরূপম’ দেখানোর উপর স্থগিতাদেশ দেয় মাদ্রাজ হাইকোর্ট। ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কমলহাসনের রফাসূত্র কোনও কাজে আসেনি।
হাইকোর্টের এই স্থগিতাদেশ আসার আগেই অবশ্য এ দিন সকালে রামানাথপুরম, থেনি, ইরোড-সহ
রাজ্যের বেশ কয়েকটি এলাকায় ‘বিশ্বরূপম’ দেখানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যেই রামানাথপুরমের দু’টি হলে মুখোশ পরা অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের একটি দল পেট্রোল বোমা ছোড়ে। হলের কাচের দরজা ভাঙচুর করে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে ওই দলের বিরুদ্ধে। পরে পুলিশ এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এক জনকে গ্রেফতার করে। অন্য দিকে মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়ের প্রতিলিপি না পাওয়ায় ফিল্মটি দেখাতে অস্বীকার করেন মাদুরাইয়ের একটি হলের মালিক। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় দর্শকদের সিনেমা হলে যেতে না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। আবার বিভিন্ন জায়গায় কমলহাসনের ভক্তেরা ফিল্মটি দেখতে চেয়ে হলের সামনে ধনার্য় বসেছেন বলেও খবর পাওয়া যায়। নতুন করে স্থগিতাদেশ আসার পরে স্বাভাবিক ভাবেই সব শো বন্ধ হয়ে যায়।
দৃশ্যতই হতাশ কমলহাসন কোর্ট চত্বরেই একটি টেবিলের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ফিল্মটি তৈরি করতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। এর জন্য তাঁকে বাড়ি-গাড়ি সব বন্ধক রাখতে হয়েছে। এখন ফিল্মটি না চললে তিনি দেনার দায়ে নিঃস্ব হয়ে পড়বেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাবেন বলেও জানান তিনি। পরে অবশ্য তিনি এবং তাঁর ভাই চারুহাসন দু’জনেই বলেন, হাইকোর্টে পরবর্তী শুনানি রয়েছে বুধবার। সে দিন কী হয় দেখে নিয়ে তবেই সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা। |
যে কোনও ছবির ক্ষেত্রেই এই রকম ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। আমার ‘বিল্লু বারবার’ এবং ‘মাই নেম ইজ খান’-এর ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছিল।
শাহরুখ খান |
|
রাজ্য জুড়ে তাঁর সিনেমা নিয়ে এত গণ্ডগোলের জন্য দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কমল বলেন, “আমি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। মকবুল ফিদা হুসেন যদি বিদেশে যেতে পারেন আমিও পারব। তবে যেখানেই থাকি, আমি তামিল ছবিই বানাব। শুধু আমার পাসপোর্টটা বদলে যাবে।”
রজনী পাশে ছিলেনই। আজ হাসনের সমর্থনে শাহরুখ খান, শ্যাম বেনেগাল থেকে শুরু করে অনেক বলিউড ও কলিউড অভিনেতা-অভিনেত্রী টুইট করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ফিল্মটি দেখানো হলে যদি শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কাই থাকে, তা হলে কেন্দ্রীয় ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড কী করে সিনেমাটি দেখানোর অনুমতি দেয়। আর তারা যদি অনুমতি দিয়ে থাকে, তা হলে কী করে ছবিটির প্রদর্শনী বন্ধ রাখা হয়? ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের প্রধান লীলা সামসন নিজেই কমলের সমর্থনে মুখ খুলেছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দেও বলেছেন, “এটা একটা গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে সবার বাক্-স্বাধীনতা রয়েছে।”
তবে কি কমল যা বলছেন, তা-ই ঠিক? এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক অঙ্ক রয়েছে? বিরোধী দল, ডিএমকে-র প্রধান করুণানিধির ইঙ্গিত কিন্তু সে দিকেই। কিছু দিন আগে একটি অনুষ্ঠানে পি চিদম্বরম, করুণানিধির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কমলও। সেখানে তিনি আগামী দিনে এক ‘ধুতি-পরিহিত প্রধানমন্ত্রী’কে দেখতে পাওয়ার আশা প্রকাশ করেন।
করুণার দাবি, কমলের ইঙ্গিত ছিল চিদম্বরমের প্রতি। আর তাতেই জয়ললিতা চটেছেন বলে ডিএমকে-র অভিযোগ। কমল নিজে কী বলছেন? তাঁর দাবি, “আমি বামও নই, ডানও নই। সে জন্যই বোধহয় আজ আমার এই অবস্থা।” |