|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
সত্যি সত্যি কবে জানালা খোলা হবে |
আশিস পাঠক |
|
‘টান দিয়ে তাই খুলে দিলাম জানালা
ও পারে যে বাংলাদেশ এ পারেও সেই বাংলা।’
নাঃ, অন্তত কলকাতা বইমেলায় বসে এমন কবিতা লেখার আগে দু’বার হাত কাঁপত পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। টান মেরে খুলে দেওয়া তো দূরের কথা, গত তিন দশক জুড়ে চেষ্টা করেও খোলা গেল না দুই বাংলার বইয়ের জানালাটা। রাজ্যে তো বটেই, এমনকী এই কসমোপলিস কলকাতাতেও বাংলাদেশের বই পাওয়ার ঠিকানা গুনতে এক আঙুলের সবকটা কড়ও বোধহয় লাগবে না।
নানা বিষয়ে সারা বছর চিন্তা করেন, চর্চা করেন যাঁরা, তাঁদের যখনই বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনও বইয়ের দরকার পড়ে তখন প্রায় সাত ঘাটের জল খেয়ে সে বই আনাতে হয়। অধিকাংশের এই অভিজ্ঞতা। সেই অধিকাংশই প্রতি বছর কলকাতা বইমেলায় নেই মামার চেয়ে কানা মামার মতো বাংলাদেশের প্রকাশনামহলের একটা প্রতিনিধিত্বের দিকে চেয়ে থাকেন। কিন্তু সেই কুণ্ঠিত উপস্থিতি আশা মেটাতে পারে না।
এবং, আজ যে ‘আন্তর্জাতিক’ কলকাতা বইমেলার উদ্বোধন তার থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ হলেও কার্যত প্রদর্শনমূলক সেই উপস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনও ব্যতিক্রম এ বারেও হচ্ছে না। দু’হাজার স্কোয়্যারফুট পরিসর বেড়েছে, প্রকাশক বেড়েছে চারটি। উদ্বোধন করছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিন্তক আনিসুজ্জামান। ক’টি আলোচনাসভা, বক্তৃতায় ও পারের চিন্তাভাবনা নিয়ে কথালাপ করবেন কয়েক জন এবং কিছু নাচগান। ব্যস। বইভুবনে দু’বাংলার নিত্য যাওয়াআসা এখনও অতি দূর।
সমস্যাটার কথা তুলতেই বাংলাদেশ থেকে দূরভাষে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক সামসুজ্জামান খানের স্বরে অসহায় আক্ষেপ, ‘‘কেন জানি না, বাংলাদেশের বইপত্র পেতে গেলে এখনও কলকাতায় ওই নয়া উদ্যোগ জাতীয় দু’একটি দোকানই ভরসা। এ বারের বইমেলাতেও তো ঢাকা বাংলা একাডেমী আগের মতোই থাকবে।’’ আর ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম বলছেন, ‘‘ শুধু সরকারি উদ্যোগে সবটা সম্ভব নয়। বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। এ বার বইমেলায় বাংলাদেশের বইয়ের চাহিদা নিয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে আমরা একটা সমীক্ষাও করব।”
অথচ এই বইমেলা নাকি ‘আন্তর্জাতিক’। হাতের কাছে হয় না খবর, কী দেখতে যাও দিল্লি লাহোর! আমেরিকা কিংবা ইংলন্ড, চিন কিংবা জাপানের কোনও প্রকাশক বইমেলায় আলাদা করে বিপণি খুলে বসবেন না তাঁর ব্যবসায়িক শুভবুদ্ধির কারণেই, কিন্তু বাংলাদেশও কেন একটি থিম প্যাভিলিয়নে তেঁতুলপাতায় ন’জন হয়ে থাকবে? বছরভর শহরের যে প্রকাশকদের বই বইপাড়ায় তো বটেই, বিবিধ ঝাঁচকচকে কিতাবস্টোরেও দেখে দেখে চোখ পচে গিয়েছে তাদের বইই আরও এক বার বইমেলা জুড়ে ছড়ানো দেখতে হবে কেন? ঘরের পাশের বাংলা ভাষার বইগুলিও কেন বইমেলায় যথেষ্ট জায়গা জুড়ে থাকবে না?
প্রশ্নগুলোর উত্তর, এ বারের মেলার প্রকৃত শিডিউলের মতোই, স্পষ্ট হয় না কোনও দিন। বাংলাদেশে একুশের বইমেলায়, আগামী মাস জুড়ে যা চলবে, এ বার নিয়ম হয়েছে সাধারণ ভাবে বাংলাদেশে না-জন্মানো কোনও লেখকের বই বিক্রি করা যাবে না। প্রয়াত ধ্রুপদী লেখকদের কথা আলাদা, আর বাংলাদেশের যে-সব প্রকাশক ভারতীয় লেখকের সঙ্গে চুক্তির বৈধ কাগজ দেখাতে পারবেন তাঁরাই ছাড় পাবেন এই নিয়ম থেকে, জানিয়েছেন একাডেমীর মহাপরিচালক।
সিদ্ধান্তটির সদুদ্দেশ্য, বাংলাদেশে জাল ভারতীয় বাংলা বইয়ের অবিরাম বিক্রি ঠেকানো। সাধু, কিন্তু এর ফলে আরও এক বার সেই সামান্য খোলা জানলাটাও বন্ধ হওয়ার শঙ্কা দেখি। তবু এ আঁধারেও এ কলকাতায় বাংলাদেশের লেখকদের কিছু বই প্রকাশিত হচ্ছে। তেমন কয়েকটি আলোর খবর থাক, শেষের সুদিনের আশায়। ‘প্রতিভাস’-এর তালিকায় সদ্য প্রকাশিত অথবা প্রকাশিতব্য বাংলাদেশের লেখকের ৫৬টি বই। উপন্যাস-গল্প তো আছেই, আছে প্রবন্ধ-নিবন্ধ, অনুবাদ, আত্মজীবনী, অভিধান এবং গান-চর্চাও। সেলিনা হোসেনের গালিবকে নিয়ে লেখা উপন্যাস যমুনা নদীর মুশায়রা, মাহবুব হাসান সালেহর কবিতার বই বৃষ্টিভেজা প্রেম, হুমায়ুন আহমেদের ১৪টি উপন্যাস, বিশ্বসাহিত্য থেকে কবীর চৌধুরীর ১১টি অনুবাদ তালিকায় উজ্জ্বল। এই সে দিন সেলিনা হোসেনের নতুন উপন্যাস সোনালি ডুমুর প্রকাশিত হল আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। ‘অভিযান’ও বাংলাদেশে প্রকাশের আগেই সরাসরি এ বাংলায় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের লেখক হাসান আজিজুল হকের টান। তবে কি ‘সম্প্রীতির বন্ধনে বই’ নিছক স্লোগান হয়েই থাকছে না আর?
কথাটা বিশ্বাস করতে বড় ইচ্ছে হয়। |
|
|
|
|
|