...পাবে নাকো তুমি

অনেক দিন মেল করা হয়নি, স্যর। আসলে পৃথিবীতে বহু দিন বাদে এলাম তো! সব কিছু কেমন বদলে গিয়েছে। চার দিকে ঝামেলা, বীণা বাজানোরও উপায় নেই।
গিয়েছিলাম মিশরে। নীল নদে ক্রুজ সেরেছি, তুতানখামেনের পিরামিড দেখেছি। তার পরে কায়রোয় ফিরে আটকে গেলাম। ভিড়ে ভিড়াক্কার, হাজারে হাজারে ছেলেমেয়ে স্লোগান দিচ্ছে। জায়গাটার নাম তাহরির স্কোয়্যার। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, সে দিনের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের লোকেরা ঘোড়ায় চড়ে, উটের পিঠে স্কোয়ারে ঢুকে পড়ছে, পুলিশের সঙ্গে তারাও বেধড়ক লাঠিচার্জ করছে। রেডিওয় মোবারক বললেন, সব বিদেশি রাষ্ট্রের চক্রান্ত। ক্ষমতা আমি ছাড়ব না।
তখনই চোখের সামনে অন্ধকার। জ্ঞান যখন ফিরল, রাস্তায় পড়ে আছি। পাশে চাপ চাপ রক্ত। শুনলাম, লাঠি, গুলি, কাঁদানে গ্যাস চালিয়ে তাহরির স্কোয়্যার থেকে সবাইকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তার পরেও লোকে ফের সেখানে গিয়েছে। পুলিশ কী করবে, স্যর? যে হোসনি মোবারক ক্ষমতা ছাড়বেন না বলেছিলেন, তিনিই পালিয়ে গেলেন। দেশের সব মানুষ গণতন্ত্রের দাবিতে, অপশাসন আর দুর্নীতি হঠানোর দাবিতে একজোট, না পালিয়ে উপায় আছে? তার পর নতুন সংবিধান, গণতন্ত্র। মহম্মদ মোরসি ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট হলেন। গত কয়েক মাস ওখানেই আটকে পড়েছিলাম, স্যর।
তাহরির স্কোয়্যারে গণতন্ত্রের দাবিতে সবাইকে যে ভাবে সরব হয়ে উঠতে দেখলাম। জানি, আপনি যুগে যুগে নতুন নামে অবতীর্ণ হন। হে শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, গণতন্ত্র নামেই কি আপনি এ বার পূজিত হবেন?

গণতন্ত্র? মর্ত্যলোকে উহা আমার নতুন নাম? সত্যি বলিতে, মর্তের মানবকুলকে আমি বিশেষ বুঝিতে পারি না, বাপু। উহারা একদা আমাকে ‘জনার্দন’ নামে ডাকিত, তাহার পর দেখিলাম, সেই নামরূপ লইয়া ‘জনতা জনার্দন’ ইত্যাদি ঠাট্টা শুরু করিল। ওই দ্বিপদ প্রাণীরা কখন কাহাকে গাছে তোলে, আবার কখন টান মারিয়া নীচে ফেলে, উহারাই জানে।
তবে, গণতন্ত্র নামটি শুনিয়াছি। পুরাকালে লোকে আমার দর্শন পাইবার জন্য তপস্যায় আত্মাহুতি দিত। সে দিন লক্ষ্মী ড্রয়িং রুমে টিভি দেখিতেছিল। আজকাল বয়সের কারণে তোমাদের মা-ঠাকরুন কিঞ্চিৎ স্থবির হইয়াছেন, পূর্বের সেই চঞ্চলা ভাবটি আর নেই। এখন বসিয়া বসিয়া শুধু চ্যানেল সার্ফ করেন।
সে দিন লক্ষ্মী আমাকে ডাকিয়া টিভিতে তিউনিসিয়া দেশের দৃশ্য দেখাইলেন। গায়ে আগুন লাগাইয়া চার-পাঁচ জন আত্মাহুতি দিতেছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, দুঃসহ দারিদ্র, বাক স্বাধীনতা না থাকা ইত্যাদি জ্বালা হইতে পরিত্রাণের উপায় খুঁজিতেছিল সে দেশের মানুষ। শেষ অবধি সকলে গণতন্ত্রের দাবিতে উত্তাল, প্রেসিডেন্ট বেন আলি পলাইয়া গেলেন। অহো, তিউনিসিয়া, মিশরের মন্ত্র পাঠ করিলে সকলে গণতন্ত্র রূপের মহিমা বুঝিবে।
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব
আপনি এখনও ব্যাকডেটেড রয়ে গেলেন, স্যর। তিউনিসিয়া, মিশরের আবার মন্ত্র কী? ওই মন্ত্রের নাম ‘জুঁই বিপ্লব’। আমাদের নন্দনকাননে এ বার শীতকালে কেমন জুঁই ফুটল, স্যর?
পশ্চিম এশিয়া আপনার নতুন রূপে মুগ্ধ। অহো, গণতন্ত্রদেবকে প্রণাম! কিন্তু টালমাটালে পেট্রোলের দাম যে ভাবে বেড়ে গেল! আগে বাতাসের এনার্জিতে ঢেঁকি চালানো যেত, কিন্তু সেখানে এত দূষণ! স্টকে কিছু পেট্রোল রাখতেই হয়।
পশ্চিম এশিয়া ছেড়ে আমি এখন হিমালয়ের পথে, স্যার। দেবতাত্মা হিমালয়, ভাবলেও রোমাঞ্চ হয়।

টু: নারদ@ঢেঁকি

নগাধিরাজকে আমার অভিনন্দন জানাইবে। বলিবে, তাঁহার কন্যা পার্বতী এক্ষণে কুশলে আছেন। সুখে সংসার করিতেছেন। হিমালয়দেশের রিপোর্ট যথাসময়ে পাঠাইয়া দিবে।

টু: নারায়ণ@বৈকুণ্ঠ

আর নগাধিরাজ! আফগানিস্থানে গোলাগুলির চোটে প্রাণ যেতে বসেছিল। পেশোয়ার দিয়ে ঢুকেছিলাম। কী বলব, স্যার? পুরো জায়গাটা আফিং পাচারকারী আর তালিবানে ভর্তি। দেখলাম, দফায় দফায় মার্কিন সৈন্য দেশে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু অবস্থা এখনও সেই রকম। গোষ্ঠীসংঘর্ষ আর থামছে না।
আফগানিস্থান থেকে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান গিয়েছিলাম। দেশগুলি আগে সোভিয়েত রাশিয়ার ব্যাকইয়ার্ড ছিল, এখন অহরহ উগ্রপন্থী ইসলামের হাতছানি। অবস্থা সুবিধের নয়, স্যার। অচিরে এরাও গণতন্ত্রদেবের দর্শন পাওয়ার জন্য ফেটে পড়তে পারে।
টু: নারদ@ঢেঁকি

সেই তুষারাচ্ছাদিত প্রান্তরের এই অবস্থা? গোলাগুলির প্রতি সবিশেষ লক্ষ রাখিও, সাবধানে থাকিও।

টু: নারায়ণ@বৈকুণ্ঠ

আর সাবধানে, স্যার? যা মেরেছে! জেলখানায় ঢুকিয়ে ইলেকট্রিক ব্যাটন দিয়ে মেরেছে, নখ উপড়ে দিয়েছে।
আমার কোনও দোষ নেই, স্যার। মাস কয়েক আগে চিনে এসেছিলাম। সাংহাই, বেজিং... সুন্দর সব জায়গা! কিন্তু ঝিনজিয়াং? সংখ্যালঘু উইগুর মুসলমানদের উপরে কড়া নজর। তিব্বতেও এক গপ্পো। ভূমিপুত্র তিব্বতিরা পুলিশের সতর্ক নজরে। বেজিং-এর রেস্তোরাঁয় এ নিয়ে গপ্পো করতে করতে কী মুশকিলে যে পড়লাম, স্যার! পুলিশ এসে সটান আমাকে জেলে পুরে দিল। এর-ওর মধ্যে কম ঝগড়া বাধিয়েছি, স্যার? সেই পাপেই বোধ হয় আজ জেল দেখতে হল।
জেলে লিউ জিয়াওবো বলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েও জেলবন্দি। ভদ্রলোকের অপরাধ? একদলীয় শাসনের অবসান চেয়ে সংবিধান সংশোধন, গণতান্ত্রিক নির্বাচন, ধর্মাচরণের অধিকার, মানবাধিকার রক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি সুরক্ষার একটি সনদ লিখেছিলেন। ব্যাস, তার পরই কারাদণ্ড। শুনলাম, ফাং লিঝি বলে এক বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছিল, তিনি দেশ ছেড়ে প্রাণে বেঁচেছেন।
আমাকে জেল থেকে উদ্ধার করুন, প্রভু নারায়ণ। আর ঢেঁকিতে চড়ব না। বিশ্বভ্রমণের সাধ আমার মিটে গিয়েছে, স্যার। সবাই গণতন্ত্রের দাবিতে উত্তাল। এর চেয়ে ভারতে থাকাই ভাল। ধর্মনিরপেক্ষ, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশ। জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে, ভারতভাগ্যবিধাতা।

কিছু কিছু লোক সব জিনিস লেটে বোঝে। দিনরাত রিপোর্টিং করতে করতে তোমার বুদ্ধিও রিপোর্টারগুলোর মতো ভোঁতা হয়ে গিয়েছে, চোখের সামনে সহজ সত্য পড়ে থাকলেও বুঝতে পারো না।
আমার কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকে সাধু ভাষার প্রোগ্রামটা ডিলিট হয়ে গিয়েছে। আরও যে কত ঝক্কি পোয়াতে হবে। আপাতত মেল করার দরকার নেই। জেলের ব্যাপারটা ভেবে দেখছি, কী করা যায়! নিশ্চয় ভাববো।
বাই দ্য ওয়ে, জেলখানায় নামগান করতে ভুলো না যেন!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.